Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm
এই তুচ্ছ কাহিনী দিয়ে আমি দেখাতে চেয়েছি যে আপাতদৃষ্টিতে একজন অসম্ভব ধৈর্যশীল কয়েদিকেও ক্ষোভ বা অবিচার বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। নিষ্ঠুরতা আর যন্ত্রণার বিরুদ্ধে ক্ষোভ নয় বরং এর সাথে জড়িয়ে থাকা অপমানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। সেসময় রক্ত আমার মাথায় উঠে যায় কারণ আমার জীবনের কাজ-কর্ম সম্পর্কে ধারনা নাই এমন এক ব্যক্তি আমার জীবনের মূল্যায়ন করছিল। সেদিনের সে ঘটনার পর আমি আমার সহ-বন্দীদের কাছে লোকটি সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছিল যে, “তাকে দেখতে এতই কুরুচিপূর্ণ আর নির্মম ছিল যে আমার হাসপাতালের বহিঃ-রোগী ওয়ার্ডের নার্স তাকে বিশ্রাম-কক্ষ বা ওয়েইটিং রুমেও ভর্তি করাতো না।” মন্তব্যটি করার পর বাচ্চাদের এক ধরনের শান্তি পেয়েছিলাম বটে।
সৌভাগ্যবশত: আমার কাজের দলের ক্যাপোটি আমার বাধ্য ছিল। আমি তার ভালবাসার কাহিনী ও দাম্পত্য কলহের কথা মন দিয়ে শুনেছিলাম বলে তিনি আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেন। আমাদের কাজের সময় তিনি তার মনে কথা উজাড় করে আমাদের বলতেন। আমি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে ও বিনামূল্যে তাকে আমার মনোচিকিৎসামূলক (psychotherapeutic) উপদেশ দেওয়া ফলে তার উপর আমি এক মানসিক প্রভাব পেলতে সমর্থ হয়। তারপর থেতে তিনি আমার প্রতি কৃতজ্ঞ-বোধ প্রকাশ করতে শুরু করেন যা ইতিমধ্যে আমার কাছে অনেক মূল্যবান ছিল । এর আগে বেশ কয়েকবার তিনি দু’শো আশি জন লোক নিয়ে গঠিত আমাদের বিশেষ কর্মী-দলের প্রথম পাঁচটি সারির মধ্যে একটি সারিতে আমার জন্য তাঁর পাশে একটি জায়গা সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। সেই অনুগ্রহটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে সময় অন্ধকার থাকা অবস্থায় ভোরে আমাদের লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল। আর দেরি করে ফেলার কারণে সবাই পেছনের সারিতে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছিল।
যদি কোনো অপ্রীতিকর এবং অপছন্দনীয় কাজের জন্য লোকের প্রয়োজন হয়, তাহলে একজন সিনিয়র ক্যাপু উপস্থিত হয়ে সাধারণত পিছনের সারি থেকে তার প্রয়োজনীয় লোক সংগ্রহ করতো। এই লোকদের অপরিচিত প্রহরীদের অধীনে বিশেষ ভয়ঙ্কর ধরনের কাজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করতে হয়। মাঝেমধ্যে সিনিয়র ক্যাপোই প্রথম পাঁচ সারি থেকে লোক বাছাই করে নিতো, যারা চালাকি করতে চেষ্টা করতো তাদের পাকড়াও করার জন্য। সব আপত্তি আর অনুরোধ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট লাথি দ্বারা শান্ত করে দেওয়া হতো, এবং চিৎকার আর কিল-ঘুসি দিয়ে বাছাই করা ভুক্তভোগীদের তাড়িয়ে এক সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া হতো।
তবে, যতক্ষণ না আমার ক্যাপো তার হৃদয় উজাড় করে কাহিনী বলার দরকার মনে করতো, ততক্ষণ আমি এসব কাজকর্ম থেকে রেহাই পেতাম। তার পাশে আমার সম্মানের স্থান নিশ্চিত ছিল। তার মাঝে আরও একটি সুবিধা ছিল। প্রায় সব সহ-বন্দীদের মতোই আমিও একবার ইডেমা রোগে ভুগছিলাম। আমার পা’দুটা ভীষণভাবে ফুলে যাওয়ার কারণে উপরের চামড়া এতই শক্তভাবে প্রসারিত হয়ে পড়েছিল যে আমি খুব কমই হাঁটু বাঁকা করতে পারতাম। আমার ফুলে যাওয়া পা’র সাথে জুতা যুতসই রাখতে আমাকে জুতোর ফিতা খোলা রাখতে হতো। মোজা থেকে থাকলেও তার জন্য তাতে কোনো জায়গা ছিলনা। তাই আমার পায়ের আংশিকটা সবসময় ভেজা আর জুতো থাকতো বরফে ভর্তি। এটি অবশ্য বরফের আঘাতজনিত যন্ত্রণা ও ঠাণ্ডাজনিত ক্ষত সৃষ্টি করতো। প্রতিটি পদক্ষেপ হয়ে উঠে প্রকৃত অত্যাচার। বরফে ঢাকা মাঠে আমাদের কুচকাওয়াজের সময় জুতোয় বরফ ডুকে শক্ত গুচ্ছ ধারণ করতো। বারবার লোকজন পা পিছলে পড়ে গেলে পেছনের লোকজন হুমড়ি খেয়ে তাদের উপর এসে পড়তো। তাতে সারিটি এক মুহূর্তের জন্যে থেমে যেতো। আর প্রহরীদের একজন দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে মানুষগুলোর উপর কাজ করতো আর তার রাইফেলের গোরা দিয়ে তাদের দ্রুত উঠে দাঁড়ানোর বাধ্য করাতো। যত বেশি আপনি সারির সামনে থাকবেন, থামিয়ে আপনাকে ততো কম বিরক্ত করা হতো। আর পায়ে ব্যথা নিয়ে দৌড়ে ক্ষতি হওয়া সময় পুষিয়ে দিতে হবে না। আমি আমার ক্যাপুর একজন সম্মানিত চিকিৎস্য হতে বা “হিজ অনার দ্য ক্যাপু” হিসেবে নিযুক্ত হয়ে খুবই খুশি হয়েছিলাম। তার কারণে সমান-তালে কুচকাওয়াজ করার জন্য আমার জায়গা হতো প্রথম সারিতে।
আমার চিকিৎসা সেবার জন্য বাড়তি মজুরী হিসেবে আমাদের কাজের স্থানে মধ্যাহ্নভোজনের সময় সুপের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত থাকতে পারতাম। সুপ পরিবেশনের সময় আমার পালা আমার পালা আসতেই তিনি সুপ পরিবেশনের বড় চামচটা চৌবাচ্চার তলায় ডুবিয়ে কিছু মটর তুলে নিয়ে আসতেন আমার জন্য। এক সময়ের এক আর্মি অফিসার এই ক্যাপু কাজের দলের মাঝিকে, যার সাথে আমি ঝগড়া করেছিলাম, সাহস করে ফিসফিসয়ে বলেছিলেন যে তিনি আমাকে একজন অস্বাভাবিক ভাল কর্মী হিসেবে জানেন। সেই ক্যাপোকে আমার শিবির জীবনে তেমন কোনো কাজে না আসলেও, তিনি বহুবার আমার জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কাজের দলের মাঝির সাথে সে দিনের ঘটনার পরের দিন তিনি (ক্যাপু) আমাকে গোপনে অন্য একটি কাজের-দলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
******
আমাদের জন্যে কষ্টবোধ করেছিলেন এমন দল-প্রধান বা মাঝিও ছিলেন যারা অন্তত নির্মাণ স্থলে আমাদের কষ্টকর পরিস্থিতিকে আরামদায়ক করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারাও অল্প সময়ের মধ্যে একজন সাধারণ শ্রমিক আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কাজ করেছে তা আমাদের মনে করিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু তাদের বলার পর একজন কয়েদি কেনো একজন সাধারণ শ্রমিকের চেয়ে কম কাজ করে তারা এর কারণ লক্ষ্য করে যে, একজন সাধারণ কর্মী প্রতিদিন ১০.৫ আউন্স রুটিতে আর ১৩⁄৪ পিন্ট পাতলা স্যুপ খেয়ে বেঁচে থাকে না। যেখানে তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে আমরা অনেক সময় তার চেয়েও কম পেতাম। একজন সাধারণ শ্রমিককে পরিবারের কোনো খবর না পেয়ে আমাদের মতো মানসিক চাপের মধ্যে দিন যাপন করতে হয়নি। যেখানে আমাদের হয় অন্য শিবিরে নতুবা তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দেওয়া হতো গ্যাস দিয়ে মারার জন্য। আমাদের ন্যায় একজন সাধারণ কর্মীকে ক্রমাগতভাবে প্রতিদিন এবং প্রতি ঘন্টায় মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়নি। কোনো এক দয়াবান দল-প্রধানকে আমি এও বলেছিলাম “আমি যেমন আপনার কাছ থেকে সড়ক নির্মাণের কাজ শিখছি, আপনি যদি আমার কাছ থেকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কিভাবে মস্তিষ্ক অপারেশন করতে হয় তা শিখতে পারেন তাহলে আপনার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ থাকবে।” আর তিনি তাতে মুচকি হেসেছিলেন।
******
বন্দীদের দ্বিতীয় স্তরের লক্ষণ যেমন, বেদনাবোধহীনতা বা অনুভূতিহীনতা ছিলো এক আত্মরক্ষার কৌশল। বাস্তবতাকে ম্লান করে সমস্ত প্রচেষ্টা আর সব আবেগ ছিল কেবল একটিমাত্র কাজকে কেন্দ্র করে: নিজের এবং অন্য সহকর্মীদের জীবন রক্ষা করা। কাজের স্থল থেকে শিবিরে ফিরে যাওয়ার সময় বন্দীদের স্বাভাবিকভাবে বলতে শুনা যেত: “ভালো, আরও একটি দিনের সমাপ্তি হলো।”
এরকম হতাশ পরিস্থিতিতে সহজেই বোঝা যায় যে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তার প্রতি একেকজন মানুষের ক্রমাগত মনোযোগী হওয়ার সম্পৃক্তাতা তার আভ্যন্তরীণ জীবনকে এক আদিম পর্যায়ে পর্যবসিত করে। মনো-বিশ্লেষণে প্রশিক্ষিত আমার কয়েকজন সহকর্মী কয়েদিদের মানসিক “Regression” সম্পর্কে প্রায় বলে থাকতেন। “Regression” মানে অধিকতর আদিম মানসিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া। তখন তার ইচ্ছা-আকাঙ্খকা আর বাসনা তার স্বপ্নে স্পষ্টতর হয়ে উঠে।
একজন কয়েদি প্রায়শই: কিসের স্বপ্ন দেখত? সে স্বপ্ন দেখত রুটির, পিঠার, সিগারেটের ও একটি উষ্ণ স্নানের। সাধারণ এই প্রত্যাশা পূরণের অভাব তাকে স্বপ্নের মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষা-সিদ্ধি বা ইচ্ছা-পূরণের দিকে চালি করে। এ স্বপ্ন তার কোনো কাজে আসলো কিনা তা অন্য বিষয়। তবে স্বপ্ন দেখা লোকটিকে শিবির জীবন আর তার স্বপ্ন বিভ্রমের মাঝে স্বপ্ন ছেড়ে ভয়ংকর বৈপরীত্যের বাস্তবতায় জেগে উঠতে হতো।
একরাতে এক কয়েদির গোঙানি শব্দে কিভাবে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছিল তা আমি কখনও ভুলবনা। দৃশ্যতই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে ঘুমের ঘোরে সে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছিল। ভয়ঙ্কর স্বপ্ন বা ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকা লোকদের জন্য যেহেতু আমি সবসময় কষ্ট পেতাম, তাই আমি বেচারা লোকটিকে জাগাতে চেষ্টা করলাম। হঠাৎ আমি যা করতে সচেষ্ট হয়েছিলাম তাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যে হাত দিয়ে তাকে নাড়া দিতে চেয়েছিলাম তা ফিরিয়ে নিয়ে আসলাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটি বিষয় নিয়ে প্রবলভাবে সচেতন হয়ে উঠলাম যে, স্বপ্ন যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেনো, তা আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা শিবিরের বাস্তবতার চেয়ে মন্দ হতে পারে না।
কয়েদিরা যে পরিমাণের উচ্চমাত্রার অপুষ্টিতে ভুগছিল তাতে করে একটা জিনিস খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, খাবারের প্রতি তাদের উচ্চ বাসনা ছিল মানুষের একটি প্রধান আদিম সহজাত প্রবৃত্তি যাকে কেন্দ্র করে আমাদের মানসিক জীবন আবর্তিত। একে অপরের কাছাকাছি কাজ করার সময় অধিকাংশ কয়েদিদের একবার দুর থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। তাতে লক্ষ্য করা যায় যে, কাজ করার সাথে সাথে তারা খাবার নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিচ্ছে। একজন তার পাশে কাজে ব্যস্ত অন্য সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করছে তার প্রিয় খাবারের ব্যাপারে। তারপর তারা রেসিপি বিনিময়ের কথা বলে এবং অদূর ভবিষ্যতে শিবির থেকে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর পুনর্মিলনীর দিনের জন্য খাবারের তালিকা তৈরির পরিকল্পনাও করেছিল। তাদের এই আলোচনা চলতেই থাকে। সবকিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে করতে তারা শুধু খাবারের কথাই বলে যেতো, যতক্ষণ না হঠাৎ করে পরিখা জুড়ে কোনো সতর্ক সংকেত বয়ে গেলো। আর এই সতর্ক সংকেত সাধারণত বিশেষ কোনো পাসওয়ার্ড বা সংখ্যা আকারে আসতো, যেমন “প্রহরী আসছে”।
*******
খাবার নিয়ে আলোচনাকে আমি সবসময়ই বিপজ্জনক ভাবতাম। যখন একজন মানুষ অত্যন্ত কম খাবার ও নিম্ন-মাত্রার ক্যালোরিতে কোনও রকম মানিয়ে নিতে সফল হয়েছিল তখন খাবারের এরকম বিশদ বর্ণনা আর আবেগ-তাড়িত চিত্রের মাধ্যমে কোনো প্রাণী সত্ত্বাকে প্ররোচিত করাটা কি ভুল নয়? সম্ভবত সে আলোচনা সাময়িকের জন্য আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক স্বস্তি নিয়ে আসবে। তবে এটি এমন এক বিভ্রম যা নিঃসন্দেহে মানসিকভাবে বিপদমুক্ত নয়। পরবর্তী বন্দীদশায় প্রতিদিন একবার খাবার হিসেবে আমাদের তরল স্যুপ ও প্রতিদিনকার ছোট একটুকরো রুটির বরাদ্দ দেওয়া হতো। প্রতিদিনের বৈচিত্রতা নিয়ে সে খাবারের পাশাপাশি ছিল তথাকথিত “অতিরিক্ত ভাতা”। তাতে থাকতো এক আউন্সের ৩/৪ অংশ মার্জারিন মাখন, অথবা নিম্নমানের এক ফালি সসেজ, বা ছোট একখানা পনির, বা একটুখানি কৃত্রিম মধু, বা এক চামচ তরল জ্যাম। আমাদের দৈনিক শারীরিক পরিশ্রম ও ক্রমাগত অপর্যাপ্ত কাপড়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বের হওয়াটা বিবেচনায় আনলে, প্রয়োজনীয় ক্যালোরি পরিমাণের দিক থেকে বিচার করতে গেলে খাবার হিসেবে আমাদের যা দেওয়া হতো তা ছিল একেবারেই অপর্যাপ্ত। ‘বিশেষ সেবা’র আওতায় থাকা অসুস্থদের অবস্থা ছিল আরও করুন। শিবির ছেড়ে যাওয়ার পরিবর্তে তাদের ছাউনিতে শুয়ে থাকার অনুমতি দেওয়া হতো।
ত্বকের নিম্নবর্তী চর্বির শেষ স্তরটি বিলীন হয়ে যাওয়ার পর আমাদের দেখে মনে হতো আমরা যেন চামড়া আর ময়লা কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কয়েকটি কঙ্কাল। আমরা দেখতে পেতাম আমাদের দেহ ক্রমে ক্রমে আমাদের গ্রাস করা শুরু করেছে। জীবদেহটি নিজের সব প্রোটিন পরিপাক করে নিয়েছে, আর মাংসপেশি হয়ে গেছে বিলুপ্ত। তার শরীরের কাছে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকলো না। আমাদের ছাউনির ছোট জনগোষ্ঠীর সদস্যরা একের পর এর এক মরে যেতে থাকে। আমরা প্রত্যেকে পরবর্তীতে কার পালা, আর তার নিজেরটা কবে আসবে তা বেশ ভালো করে অনুমান করতে পারতাম। অনেক পর্যবেক্ষণের পর আমরা তার লক্ষণ বুঝতে পারতাম, যা আমাদের ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতা বেশ নিশ্চিত করতো। “সে আর বেশি দিন টিকবে না”, বা “এটি পরবর্তীটা”, বলে আমরা একে অন্যের কাছে কানাকানি করতাম। আর আমাদের দৈনিক উকুন বাছার সময় সন্ধ্যায় আমরা আমাদের নগ্ন শরীর দেখে ভাবতাম: আমার এই দেহটি ইতিমধ্যেই বস্তুত একটি লাশে পরিণত হয়েছে। আমার কি পরিণতি হয়েছে? আমি মানবীয় মাংসের বিশাল এক পিণ্ডের ছোট এক অংশ ব্যতীত আর কিছুই নয়…বৈদ্যুতিক তারের পেছনে, মাটির তৈরি কয়েকটি ছাউনিতে ভিড় করা মানবীয় মাংস পিণ্ড। প্রাণহীন হয়ে পড়ার কারণে যে পিণ্ডের একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রতিনিয়ত পচতে শুরু করে দিয়েছে।
খাদ্য আর প্রিয় সব খাবারের চিন্তা যে কতোটা অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে তা আমি উপরে উল্লেখ করেছি। অবসর আসলেই তা একজন কয়েদির চৈতন্যে জোর করে ফিরে আসে। সম্ভবত এটি বোঝা যায় যে, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিটিও এমন এক সময়ের আকাঙ্খকা করছিল যখন সে পুনরায় ভাল খাবার খেতে পারবে। ভাল খাবারে স্বার্থে ভালো খাবার নয় বরং আমাদের যে অর্ধ-মানবিক জীবন খাদ্য ব্যতীত অন্য কিছুর কথা ভাবতে অক্ষম করে তুলেছিল তাকে বোঝার স্বার্থে।
যারা এরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি তারা আত্মা-বিনষ্টকারী এই মানসিক সংঘাত আর একজন ক্ষুধার্ত মানুষের অনুভব করা ইচ্ছাশক্তির দ্বন্দ্বের কথা খুব কমই ধারনা করতে পারে। তারা বুঝতে পারবে না যে পরিখা খননের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাইরেনে সকালের নাস্তার জন্য আধা ঘণ্টা বিরতির ৯:৩০ বা ১০:০০ টা ঘোষণা শোনার অনুভূতি। আর মাঝি যদি ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তি না হয়ে থাকে তাহলে বার বার তার কাছে কয়টা বাজে জিজ্ঞেস করা; আর কারো কোটের পকেটে থাকা রুটির টুকরোটি সযত্নে স্পর্শ করে প্রথমে হিমায়িত মোজা-হীন আঙ্গুল দিয়ে হাত বুলিয়ে তারপর একটুকরো ভেঙ্গে নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে অবশেষে, ইচ্ছাশক্তির শেষটুকু দিয়ে, পুনরায় আর অর্ধেক পকেটে ঢুকিয়ে রেখে নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করা যে এইটুকু দুপুর পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে হবে।
আমাদের বন্দী অবস্থার পরবর্তী সময়ে প্রতিদিনের দেওয়া ছোট রুটির বরাদ্দ বণ্টনের নির্দিষ্ট পদ্ধতির অর্থ-অনর্থ নিয়ে আমরা অন্তহীন বিতর্ক তুলতে পারি। বরাদ্দ বণ্টনের পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে দুইটি আলাদা মতধারা সৃষ্টি হয়েছিল। একদল মনে করতো আমাদের বরাদ্দ দেওয়া রুটিটি বাঁচিয়ে না রেখে তৎক্ষণাৎ খেয়ে ফেলা উচিৎ। প্রথম বিতর্ক অনুযায়ী তাতে খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও অন্ততপক্ষে দিনে একবার ক্ষুধার তীব্রতা নিবারণ সুযোগ ও খাদ্যের সম্ভাব্য চুরি যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো দ্বিগুণ সুবিধা আছে। দ্বিতীয় পক্ষ ভিন্ন মতের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত খাদ্যকে ভাগ করে খাওয়ার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল। আর শেষমেশ আমি দ্বিতীয় পক্ষের কাতারে যোগ দিই।
শিবির জীবনের চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে সবচেয়ে ভয়ানক ছিল ঘুম থেকে জেগে উঠা। রাত্রের নীরবতার মাঝে বাঁশির তিনটি তীক্ষ্ণ ফুঁ ক্লান্তির ঘুমটুকু এবং তীব্র বাসনার স্বপ্নটুকু আমাদের কাছ নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নিতো। ইডেমার কারণে পায়ে ক্ষত ও পা ফুলে যাওয়ায় আমরা আমাদের পা ঢুকাতে না পারলে জুতোর সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিতাম। তার উপর ছিল জুতোর ফিতার পরিবর্তে ব্যবহৃত হওয়া তার কামড়িয়ে ভাঙ্গা নিয়ে তুচ্ছ সমস্যা নিয়ে স্বাভাবিক কান্নাকাটি আর হায়-হুতাশ। যাকে আমি সাহসী আর বীরত্বপূর্ণ মনে করতাম সেও দেখি এক সকালে বাচ্চার মতো কাঁদছে কারণ শেষমেশ তাকে খালি পায়ে বরফে-ডাকা মাঠে কুচকাওয়াজের যেতে হচ্ছিল। তার জুতোগুলি এতই কুচকে গিয়েছিল যে তা সে আর পড়তে পারছিলো না। সেই ভয়ানক মুহূর্তেই আমি একটু সান্ত্বনা খুঁজে পায়; রুটির টুকরোটি বের করে এনে এনে নিবিড় আনন্দে তা চিবুতে থাকলাম।
পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি খাবারের প্রতি আমাদের সহজাত সার্বক্ষণিক চিন্তার কারণেই হয়তো সাধারণভাবে শিবিরে যৌন তাড়না ছিল না। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের প্রাথমিক প্রভাব ব্যতীত, পুষ্টিহীনতা এবং খাবারের মানুষের সহজাত সার্বক্ষণিক চিন্তা-ই এমন ঘটনার একমাত্র ব্যাখ্যা যা একজন মনোবিজ্ঞানীকে পুরুষ অধ্যুষিত শিবির সমূহ পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য করে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, সেনানিবাসের মতো পুরুষ অধ্যুষিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় শিবিরে যৌন বিকৃতি ছিল কম। এমনকি স্বপ্নেও একজন বন্দীকে যৌনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়েছে বলে মনে হয়নি, যদিও তার প্রতিহত আবেগ আর সুন্দরতম, উচ্চতর অনুভূতি সমূহ স্বপ্নেই সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি খুঁজে পায়।
Comments are closed.