ভারত এবং বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য | India and balance of global power

ভারত এবং বৈশ্বিক ক্ষমতা ও ভারসাম্য রক্ষার লড়াই | India and Balance of Global Power

  • Post author:
  • Post last modified:24 January 2024

Last updated on January 24th, 2024 at 03:39 pm

ভারত এবং আমেরিকার “সমন্বিত মূল্যবোধ” সম্পর্কে সরকারি বিবৃতি কোনো জোট তৈরি করে না। রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যের মৌলিক মূল নীতি অনুসরণ করলে বোঝা যায় যে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিবাহের জন্য নয় বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বের জন্য অবধারিত বলে মনে হচ্ছে – যা কেবল ততক্ষণ স্থায়ী হতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত উভয় দেশই চীনকে নিয়ে ব্যস্ত আছে।

ভারত এবং বৈশ্বিক ক্ষমতা

এই মাসে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন অনেক পর্যবেক্ষক চীনের বিরুদ্ধে একটি ক্রমবর্ধমান জোটের তৈরি প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু এই ধরনের প্রত্যাশা হলো অতিমাত্রার উত্তেজনা। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর যেমন স্পষ্ট করেন, যে কোনো আনুষ্ঠানিক জোট কার্ডের মধ্যে নেই, তা এমনকি বহুমুখী frenemy’র (frenemy হলো এমন কোনো ব্যক্তি মৌলিক কোনো অপছন্দ বা বিরোধিতা থাকলেও যার সাথে কোনো ব্যক্তি বন্ধুত্বসূলব আচরণ করে) বিশ্বে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হলেও৷”

ঔপনিবেশিকোত্তর ভারতের জোট সম্পর্কে অবিশ্বাসের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তবে তা দীর্ঘকাল ধরে চীনের সাথে মনোযোগ আচ্ছন্ন করে রেখেছে জড়িত ছিল, অন্তত ১৯৬২ সালের দু’দেশের হিমালয় সীমান্ত যুদ্ধের পর থেকে। রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের প্রশাসনে কাজ করার সময়,  প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে দক্ষিণ এশীয় পারমাণবিক-অস্ত্র-মুক্ত অঞ্চল সমর্থনে উৎসাহিত করার জন্য আমাকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল, যেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক প্রতিযোগিতা হাতছাড়া না হয়ে যায়। সে সময় যেমনটি আমার ভারতীয় আয়োজকেরা আমাকে বলেছিল, তারা চেয়েছিল ভারতে দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তানের সাথে নয়, বরং পূর্ব এশিয়ার চীনের সাথে তুলনা করা হোক।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এর সন্ত্রাসী হামলার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত তখনও সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন প্রাক্তন কূটনীতিকদের মধ্যে ২০ বছরের পুরোনো  “Track Two” আলোচনা শুরু করে। ( Track Two or track  II diplomacy or backchannel diplomacy হল বেসরকারি, অনানুষ্ঠানিক এবং বেসরকারি যোগাযোগ এবং ব্যক্তিগত নাগরিক বা ব্যক্তি গোষ্ঠীর মধ্যে বা  অ-রাষ্ট্রীয় মুখপাত্রের মধ্যে কার্যকলাপের অনুশীলন।)

(উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান প্রতিনিধি দলের মধ্যে ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার এবং রিচার্ড হলব্রুকের মতো ব্যক্তি।) ভারতীয় অংশগ্রহণকারীরা তাদের মার্কিন প্রতিনিধিদের কাছে  আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে আল-কায়েদা এবং অন্যান্য চরমপন্থি হুমকির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, কিন্তু তারা এটাও স্পষ্ট করেছিলেন যে ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে আমেরিকানদের ” হাইফেন দ্বারা সংযুক্ত” চিন্তা করার প্রবণতাকে আপত্তি করেন ।

ভারতীয়রাও চীন সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিল, কিন্তু তারা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছিল – এবং চীনা বাজারে প্রবেশাধিকার চেয়েছিল। চীন দীর্ঘদিন ধরে ভারতের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার, তবে চীনো অর্থনীতি ভারতের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারের বিনিময় হার ব্যবহার করে, এই শতাব্দীর শুরুতে চীন  বিশ্ব জিডিপির  ৩.৬% প্রতিনিধিত্ব করেছিল, কিন্তু ভারত ২০২০ সাল পর্যন্ত সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

২০০০-এর দশকে যখন চীনের প্রবৃদ্ধি ভারতের চেয়ে অনেক অনেক বেশি এগিয়েছিল, Track Two আলোচনায় ভারতীয়রা কেবল পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থন নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিল তা নয়, বরং আরও ব্যাপকভাবে চীনের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক শক্তি নিয়েও চিন্তিত ছিল। যেমনটি এক ভারতীয় কৌশলবিদ যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে লিখেছেন, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমরা চীনকে অপছন্দ করার চেয়ে তোমাকে কম অপছন্দ করি” – আর তা ছিল ২০২০ সালের বিতর্কিত হিমালয় সীমান্তে সংঘর্ষের অনেক আগে, যেখানে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছিল।

এরপর থেকে ভারত-মার্কিন সহাবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এক দশক আগে, মার্কিন, ভারতীয়, জাপানি এবং অস্ট্রেলিয়ান কূটনীতিকদের মধ্যে চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ (Quad) সম্মেলন সমূহকে অবজ্ঞা করা হয়েছিল; এখন, সেসব সম্মেলন সম্পর্কে উচ্চস্বরে প্রচার করা হয় এবং সরকার প্রধান পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়। আজকে ভারত অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বেশি যৌথ সামরিক মহড়া করছে।

কিন্তু এই আয়োজন জোট থেকে অত্যন্ত ভিন্ন কিছু। ভারত এখনও তার অর্ধেকেরও বেশি অস্ত্র আমদানি করে রাশিয়া থেকে, ও রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত তেলের প্রধান ক্রেতা (চীনের পাশাপাশি), আর প্রায়শই জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। প্রকৃতপক্ষে, ভারত এখন পর্যন্ত  ইউক্রেনে রাশিয়ার ২০২২ সালের আক্রমণের নিন্দা করতে অস্বীকার জানিয়েছে, ঠিক যেমনটি ভারত ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণের নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছিল৷ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসাবে ভারতের সমস্ত আত্ম-অভিনন্দনের সত্ত্বেও, ভারত গণতান্ত্রিক ইউক্রেনের সুরক্ষায় এগিয়ে আসেনি। ভারতের শীর্ষ অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে অস্ত্র এবং তেলে প্রবেশাধিকার বজায় রাখা এবং রাশিয়াকে আরও চীনের বাহুয় ঠেলে দেওয়া এড়িয়ে চলা।

যদিও বাইডেন মোদীকে গণতন্ত্র নিয়ে সম্মেলনে ডেমোক্রেসিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তারপরও  হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতি মোদির সংকীর্ণমনা মনোভাবের নিন্দা করার জন্য পশ্চিমা এবং ভারতীয় সমালোচকদের অভাব নেই । দুটি বৃহত্তম গণতন্ত্রের “সমন্বিত মূল্যবোধ” সম্পর্কে সাম্প্রতিক দেওয়া বিবৃতি সমূহ সুন্দর শ্রুতিমধুর শোনালেও তা জোট তৈরি কাজ করে না। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের চাবিকাঠি হল চীনের সাথে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং এতে ভারতের অস্থান।

এ ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব বাড়ছে। এই বছরের শুরুতে, দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসাবে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে ভারতে জনসংখ্যা ১.৪ বিলিয়নে পৌঁছেছে সেখানে চীন জনসংখ্যাগত পতনের সম্মুখীন হয়েছে, যেখানে শ্রমশক্তি শীর্ষে পৌঁছেছে। তদুপরি, বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়ে ভারতের অর্থনীতি এই বছর ৬% প্রসারিত হওয়ার পথে –যা চীনের চেয়ে দ্রুত । তা যদি এই হারে চলতে থাকে তবে দেশটি এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইউরোজোনের অর্থনীতির সমান আকার হতে পারে।

বিশাল জনসংখ্যা, পারমাণবিক অস্ত্র, একটি বৃহৎ সেনাবাহিনী, ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তি, শক্তিশালী অভিজাত শিক্ষা, উদ্যোক্তাতাবাদের সংস্কৃতি, এবং বৃহৎ এবং প্রভাবশালী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে বসবাস করা ভারতীয়দের সাথে যোগসূত্র নিয়ে, বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকবে। তবে এক্ষেত্রে কারও নিয়ন্ত্রণ হারানো উচিত নয়। ভারত একাই চীনের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না, কারণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনের বড় ধরনের প্রারম্ভিক সুবিধা রয়েছে। চীনের অর্থনীতি প্রায় পাঁচগুণ বড়, আর দারিদ্রতা এখনও ভারতে বিস্তৃত। ভারতের ৯০০ মিলিয়ন কর্ম-বয়সী মানুষের মধ্যে, শ্রমশক্তিতে রয়েছে মাত্র অর্ধেকই  আর এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মহিলা নিরক্ষর। ভারতের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে সম্ভাব্য দায়/দায়বদ্ধতার পরিবর্তে অর্থনৈতিক সম্পদে পরিণত করতে হলে একে প্রশিক্ষিত করতে হবে। যদিও চীনের শ্রমশক্তি শীর্ষে পৌঁছালেও তা উচ্চতর গড় শিক্ষার স্তরের উপর নির্ভর করে।

গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ক্ষেত্রে বাণিজ্যের নৈর্বাচনিক পৃথককরণ সত্ত্বেও, ভারত এখনও চীনা বাজারে প্রবেশাধিকার ত্যাগ করতে চায় না। ভারত যখন চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ (Quad) সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে তখন দেশটি সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা এবং BRICS (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা) এর পর্যায়ক্রমিক বৈঠকেও অংশগ্রহণ করে। ভারত আর জোটনিরপেক্ষতার কথা বলে না বললেও সীমাবদ্ধ জোটেও আগ্রহী নয়। রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যের মৌলিক যুক্তি অনুসরণ করে, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিবাহের জন্য নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বের জন্য অবধারিত বলে মনে হচ্ছে – যা কেবল ততক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে যতক্ষণ না উভয় দেশ চীন সম্পর্কে উদ্বিগ্ন থাকছে।


জোসেফ এস. নীয়ে, জুনিয়র, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষা সচিব, Do Morals Matter? Presidents and Foreign Policy from FDR to Trump এর লেখক। প্রবন্ধটি Project Syndicate এর India and Balance of Global Power এর বাংলা অনুবাদ। 

Romzanul Islam

Thinking out of the convention and moving forward with knowledge and reasons are always my styles. Researching, watching the best films, and reading and collecting the best books to enrich me is my deadly passion. Stoicism, liberalism, feminism and aversion to material success are my ideals.