man's search for meaning Bangla translation

Man’s Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023

  • Post author:
  • Post last modified:24 January 2024

Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm

তবে জীবনের অর্থ’র তৃতীয় উপায়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: অ্সহায় পরিস্থিতির একমনকি অসহায় ভোক্তভুগিও, তার পক্ষে পরিবর্তন করা অসম্ভব নিয়তির মুখোমুখ হয়ে, নিজেকে উর্ধে উত্থিত করতে পারে, তার নিজের উর্ধে বিকশিত হতে পারে, আর তার সম্পাদনের মাধ্যমে পারে নিজেকে পরিবর্তন করতে। সে নিজের ব্যক্তিগত দুর্দশাকে এক বিজয়ে পরিণত করতে পারে। পুণরায়, এডিথ ওয়েসকপফ জুয়েলসন, যিনি এক সময় আশা ব্যক্ত করেছিলেন যে লগোথেরাপি, “যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সংস্কৃতিতে নির্দিষ্ট অস্বাস্থ্যকর প্রবণতাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে, যেখানে একজন দুরারোগ্য ভুক্তভোগীকে তার যন্ত্রনাভোগ সম্পর্কে গর্বিত হওয়ার এবং একে মর্যাদা হানিকরের বদলে মর্যাদাসম্পন্ন বিবেচনা করার খুব কমই সুযোগ দেওয়া হয়” যার কারণে, “সে কেবল অসুখি নয় বরং অসুখি হওয়া সম্পর্কে লজ্জিতও হয়”।

পঁচিশ বছর সময় ধরে, আমি সাধারণ হাসপাতালের স্নায়ুতাত্ত্বিক বিভাগ পরিচালনা করেছিলাম এবং আমার রোগীদের সামর্থ কিভাবে তাদের দুরবস্থাকে মানব সফলতায় রুপান্তর করেছিল তার সাক্ষী ছিলাম। এরকম বাস্তব অভিজ্ঞতার পাশাপাশি, এমন গবেষণামূলক প্রমানও রয়েছে যা একজন মানুষ যে তার যন্ত্রনাভোগে জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে পারে তার সম্ভাবনাকে সমর্থন করে। ইয়েইল ইউনিভার্সিটি অব মেডিসিন এর গবেষকেরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের যুদ্ধ বন্দীদের সংখ্যা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল যারা পরিষ্কারভাবে দাবি করেছিল যে তাদের বন্দী জীবন নির্যাতন, ব্যাধি, অপুষ্টি ও নির্জন অবরুদ্ধতায় পূর্ণ থাকার দরুর মানসিকভাবে অসাধারণ কষ্টকর হলেও তদুপরি বন্দীত্বের অভিজ্ঞতাকে ক্রমবৃদ্ধির এক অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখে তা থেকে তারা লাভবান হয়েছিল।[1]

তবে “দুঃখনক আশাবাদের” পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী বিতর্ক সেগুলিই যাদের ল্যাটিন ভাষায় argumenta ad hominem বা বিতর্কের পরিবর্তে বরং প্রতিপক্ষ ব্যক্তির চরিত্র, আগ্রহ বা অনুভূতির সুযোগ নেওয়াকে বোঝায় । লগোথেরাপি মতে উদহারণ হিসেবে “মানবাত্মার অদম্য শক্তি’র জেরি লং তার এক জীবন্ত সাক্ষ্য।[2] টেক্সারকানা গ্যাজেট পত্রিকার উদ্বৃতি দিয়ে বলতে হয় “জেরি লং এক ডাইভিং দুর্ঘটনার পর থেকে তার ঘাড় থেকে নিচে অবশ হয়ে আছেন যা তার সকল চার প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে তিন বছর আগে। দুর্ঘটনা হওয়ার সময় তার বয়স ছিল ১৭। আজকে টাইপ করার জন্য লং মাউথ স্টিক বা মুখ-কাঠি ব্যবহার করতে পারে। বিশেষ টেলিফোনের মাধ্যমে তিনি দু’টি কমিউনিটি কলেজ কোর্সে অংশগ্রহন করেন। ইন্টারকম বা আন্তযোগাযোগব্যবস্থা লংকে শ্রেণীকক্ষের আলোচনা শুনতে ও তাতে অংশগ্রহন করার সুযোগ করে দেয়। তিনি পড়ার মাঝে, টেলিভিশন দেখায় এবং লেখালেখিতে তার সময়ক ব্যয় করেন”। আর তার কাছ থেকে গ্রহন করা এক চিঠিতে তিনি লিখেন: “আমি আমার জীবনকে অর্থ আর উদ্দেশ্যে ভরপুর হিসেবে দেখি। যে মনোভাব আমি সেই ভয়াবহ দিনে গ্রহন করেছিলাম তা সারা জীবনের জন্য আমার ব্যক্তিগত মতবাদ হয়ে উঠে: আমি আমার ঘাড় ভেঙ্গেছি, কিন্তু তা আমাকে ভাঙ্গেনি। আমি সম্প্রতি কলেজে আমার প্রথম মনস্তাত্ত্বিক কোর্সে ভর্তি হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি যে আমার অচলাবস্থা অন্যকে সাহায্য করার জন্য কেবল আমার সামর্থকেই বৃদ্ধি করবে। আমি জানি যে যন্ত্রনাভোগ করেছি তা ব্যতীত, আমি যে মানসিক বিকাশ অর্জন করেছি তা কখনও সম্ভব হতো না”।

এটা বলা কি আবশ্যক যে জীবনের অর্থ আবিষ্কারের জন্য যন্ত্রনাভোগ অপরিহার্য? কোনো ভাবেই না। আমি কেবল জোর দিয়ে বলতে চাই যে যন্ত্রনাভোগ সত্ত্বেও জীবনের অর্থ পাওয়া যায়, যদি, যেমনটি এই বইয়ের ‍দ্বিতীয় অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি সেই যন্ত্রনাভোগ হয়ে উঠে অপরিহার্য। যদি তা অপরিহার্য হয়ে উঠে, তাহলে এর কারণ অপসারণই হলো অর্থবহ কাজ, কারণ অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রনাভোগ বীরত্বের চেয়ে হয়ে উঠে মর্ষকামীমূলক। যদি, অন্য অর্থে, কোনো ব্যক্তি তার যন্ত্রনার কারণ পরিবর্তন করতে  না পারে, তবুও সে যন্ত্রনার প্রতি তার মনোভাব নির্বাচন করতে পারে।[3] লং তার ঘাড় ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নেননি, বরং তিনি তার উপর যা ঘটেছে তার দ্বারা নিজেকে ভাঙ্গতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

আমরা যেমনটি লক্ষ্য করি, অগ্রাধিকার থাকে আমাদের যন্ত্রনার কারণ হওয়া অবস্থার সৃজনশীলভাবে পরিবর্তনের সাথে। কিন্তু “কিভাবে যন্ত্রনাভোগ করতে হয় জানা”র সাথে থাকে উৎকৃষ্টতা, যদি প্রয়োজন হয়। আর এমন গবেষণামুলক প্রমানও আছে যে – আক্ষরিকভাবে – যার সম্পর্কে “রাস্তার মানুষটি”র কাছেও একই মতামত রয়েছে। অস্ট্রিয়ার জনমত জরিপে অংশগ্রহনকারী ব্যক্তিরা সম্প্রতি প্রকাশ করে যে সাক্ষাৎকার নেওয়া অধিকাংশ মানুষ যাদেরকে মানুষ মর্যাদার সর্বোচ্চ স্থানে বসিয়েছে তারা কেউই মহান শিল্পি বা বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন না কোনো মহান রাষ্ট্রনায়ক বা মহান কোনো ক্রিয়া ব্যক্তিত্ব, বরং যারা তাদের উচ্চ শিরে কঠিন নিয়তিকে নিয়ন্ত্রন করেছিল তাদেরই সম্মানে উচ্চ স্থানে বসানো হয়েছিল।

দুঃজনক ত্রয়ীর ‍দ্বিতীয় দিকে ফিরলে, যেমন অপরাধবোধ, আমি ধর্মতত্ত্বীয় ধারণা থেকে প্রস্থান করতে চাই যা সবসমই আমাকে মুগ্ধ করে আসছিল। আমি যাকে mysterium iniquitatis বলা হয় তার দিকে নির্দশ করবো, যার মানে হলো, আমি যেমনটি লক্ষ্য করি, যে কোনো অপরাধ চুড়ান্ত বিশ্লেষণে অবর্ণনীয় থেকে যায় কারণ একে পূর্নাঙ্গভাবে জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক বা সমাজতাত্ত্বিক উপাদানে সনাক্ত করা যায় না। কারো অপরাধকে পূর্নাঙ্গভাবে ব্যাখ্যা করাটা হবে তার অপরাধকে ব্যাখ্যা করার এবং তার মাঝে এক মুক্ত আর দায়বদ্ধ মানুষ না দেখার কিন্তু তাকে মেরামতযোগ্য এক যন্ত্র হিসেবে দেখার সমতুল্য। এমনকি অপরাধীরাও নিজেরা এই আচরণকে ঘৃণা করে এবং তাদের কর্মের জন্য দায়বদ্ধ হওয়াকে শ্রেয় মনে করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের কারাগারে তার কারাদণ্ড ভোগ করা একজন অপরাধীর কাছ থেকে আমি একটি চিঠি পেয়েছিলাম যাতে সে আক্ষেপ করেছিল যে, “নিজেকে ব্যাখ্যা করার জন্য একজন অপরাধীর কখনও সুযোগ থাকে না। নির্বাচন করার জন্য তার কাছে বহুবিধ অজুহাত উপস্থাপন করা হতো। সমাজকে দোষারোপ করা হয় এবং অনেক ঘটনায় দোষ দেওয়া হয় ভোক্তভুগীকে”। অধিকন্তু, আমি যখন কালিফুর্নিয়ার স্যান কুয়েন্টিন কারাগারে বন্দীদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছিলাম, তখন আমি তাদের বলেছিলাম যে, “আপনারাও আমার মতো মানুষ, আর তদুপরি অপরাধী হওয়ার জন্য অপরাধ সংঘটনে আপনারা মুক্ত ছিলেন। এখন, যদিও, আপনারা অপরাধবোধের উর্ধে উঠে, নিজেদের উর্ধে বিকশিত হওয়ার মাধ্যমে, ভালোর জন্য পরিবর্তীত হয়ে তাকে অতিক্রম করার জন্য দায়বদ্ধ”। তারা মনে হয় বুঝতে পেরেছিল।[4] এবং এক সাবেক কারাবন্দী, ফ্রাঙ্ক ই. ডব্লিউ থেকে আমি একটি চিরকুট পেয়েছিলাম যাতে সে বলেছিল যে “সাবেক-অপরাধীদের জন্য একটি লগোথেরাপি দল শুরু করেছি। আমাদের আসল দলের সহকর্মিদের শক্তির মাধ্যমে আমরা ২৭ জন শক্তিশালী ও নতুন আগন্তুকরা জেলখানার বাইরে কাটাচ্ছি। কেবল একজন ফিরে গেছে- আর সে এখন মুক্ত। [5]

সমষ্টিগত অপরাধবোধ’র বেলায়, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে কাউকে অন্য জনের বা ব্যক্তির সমষ্টির আচরণের জন্য দায়ী করা সম্পুর্ণভাবে অন্যায়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শেষে, জনসম্মুখে সমষ্টিগত অপরাধবোধ ধারণার বিরুদ্ধে তর্ক করতে আমি ক্লান্ত হয়নি।[6] মাঝে মধ্যে, যদিও, মানুষকে তাদের কুসংস্কার থেকে পৃথক করতে প্রচুর শিক্ষকসুলভ কৌশলের প্রয়োজন হয়। একজন আমেরিকান মহিলা এক সময় ভর্ত্সনার সাথে আমার মুখোমুখি হয়, “আপনি কি করে এখনও এ্যাডল্ফ হিটলারের জার্মান ভাষায় বই লিখতে পারেন?” প্রতিত্তোরে, আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার রান্না ঘরো ছুরি ছিল কি না, আর যখন সে উত্তর দিলো যে তার ছুরি ছিলো, তখন আমি হতাশ আর বিস্মিত হওয়ার ভান করে বিস্ময়ের সাথে বলেছিলাম, “আপনি কিভাবে সে ছুরিকে এখনও ব্যবহার করছেন যা ব্যবহার করে খুনিরা বহু ভোক্তভুগীকে ছুরিকাঘাত করেছিল ও হত্যা করেছিল?” তখন সে জার্মান ভাষায় আমার বই লেখা নিয়ে আপত্তি করা থামিয়ে দেয়।

দুঃখজনক ত্রয়ীর তৃতীয় দিক মৃত্যু সম্পর্কে। কিন্তু তা জীবনকেও সম্পর্কযুক্ত করে, কারণ যে কোনো সময় জীবন গঠিত হয় এমন প্রতিটি মুহুর্ত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, আর সে মুহুর্তটি কখনও পুনরাবৃত্তি হবে না। আর তারপরও এই ক্ষনস্থায়ীত্ব কি এক স্মৃতিচিহ্ন নয় যা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের সম্ভাব্য সর্বোত্ত ব্যবহারে আমাদের চ্যালেঞ্জ করে? অবশ্যই, এবং তাই আমার অত্যাবশ্যক কাজ: “বেঁচে থাকুন যেন আপনি ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় বারের মতো জীবন-যাপন করছেন এবং আপনি যেমন এখন ভুলভাবে আচরণ করতে যাচ্ছেন ঠিক একই আচরণ যেন আপনি প্রথমবার করেছিলেন”।

বস্তুত, যথাযথভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ, কোনো অর্থ পূর্ণ করার সম্ভাবনা আমাদের জীবনের অপরিবর্তনীয়তার দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু সম্ভাবনা সমূহও স্বতন্ত্রভাবে প্রভাবিত। কারণ যখনই আমরা কোনো সুযোগ ব্যবহার করেছি এবং সম্ভাব্য অর্থ’কে বাস্তবায়িত করেছি, তা আমরা একবারের জন্যেই করেছি। আমরা তাকে অতীতে সংরক্ষণ করেছি যেখানে তাকে নিরাপদভাবে সরবরাহ করা হয়েছে আর গচ্ছিত রাখা হয়েছে। অতীতের কাছে কোনো কিছুই অপূরণীয়ভাবে হারিয়ে যায় না, বরং বৈপরিতভাবে, সবকিছুই অপরিবর্তনীয়ভাবে সংরক্ষিত ও সঞ্চিয়ীত। নিঃসন্দেহে, মানুষ ক্ষণস্থায়ীত্বের কেবল খড়ের মাঠ দেখতে প্রবণ কিন্তু, অতীতের পূর্ণ শস্যভাণ্ডার যার ভেতর তারা তাদের জীবনের শস্য আহরণ করেছে তাকে উপেক্ষা করে এবং ভুলে যায়: কৃত কর্ম, কৃত প্রেম, আর অবশেষে, সাহস আর মর্যাদার সাথে তারা যে যন্ত্রনা পার করে এসেছে।

এখান থেকে কেউ লক্ষ্য করে থাকবে যে বয়স্ক মানুষের প্রতি করুণা করার কোনো কারণ নেই। তার বদলে, যুবক লোকদের উচিৎ তাদের ঈর্ষা করা। এটি সত্যি যে বসয়স্ক মানুষের ভবিষ্যতে কোনো সুযোগ নেই, নেই কোনো সম্ভাবনা। কিন্তু তাদের তার চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে। ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বদলে, তাদের রয়েছে অতীতের বাস্তবতা- যে সম্ভাবনা মসূহকে তারা বাস্তবায়িত করেছিল, যে অর্থ’কে তারা পূর্ণ করেছিল, যে মূল্যবোধকে তারা অনুধাবন করেছিল- আর কোনো কিছু এবং কেউই এসব সম্পদকে তাদের অতীত থেকে অপসারণ করতে পারে না।

যন্ত্রনাভোগের মধ্যে জীবনের অর্থ খুজে পাওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা করলে, জীবনের অর্থ আসলে শর্তহীন, অন্তত সম্ভাবনীয়রূপে। যাইহোক, সেই শর্তহীন অর্থকে প্রত্যেক মানুষের শর্তহীন মূল্যবোধের দ্বারা সমান্তরাল করা হয়েছে। এটি হলো সেই অর্থ যা মানুষের আত্ম-মর্যাদার অমোচনীয় গুনাগুনের নিশ্চয়তা দেয়। ঠিক যেভাবে জীবন যেকোনো পরিস্থিতিতে, এমনকি সবচেয়ে সংকটময় পরিস্থিতিতেও, সম্ভাবনীয়রূপে অর্থপূর্ণ রয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই প্রতিটি মানুষের মূল্যবোধও তার সাথে অবস্থান করে, আর তা তার অতীতের বাস্তবায়িত মূল্যবোধের উপর নির্ভর করেই হয়ে থাকে, এবং তা বর্তমানে কেউ তার প্রয়োজনীয়তা বজায় রাখতে পারলো কি পারলো না তার  মুখাপেক্ষি নয়।

আরও নির্দষ্টিভাবে বলতে গেলে, জীবনের এই অর্থপূর্ণতা স্বভাবতই সমাজের কল্যাণের কার্যকারিতার ভিত্তিতে সজ্ঞায়িত। কিন্তু আজকের সমাজকে অর্জন স্বার্থ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়, আর ফলশ্রুতিতে সমাজ সফল আর সুখি ব্যক্তিদেরই বন্দনা করে, বিশেষ করে, সমাজ যুবকদের বন্দনা করে। ফলতঃ সমাজ ভিন্ন মতের, ভিন্ন ধারার মানুষদের মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে, আর তার মাধ্যমে আত্ম-সম্মানবোধে মূল্যবান হওয়া এবং কার্যকারিতার বোধে মূল্যবান হওয়ার মধ্যে সুস্পষ্ট ভিন্নতাকে দুর্বোধ্য করে তোলো। কেউ যদি এই ভিন্নতা সম্পর্কে অবগত না হয়ে থাকে আর যদি ভেবে থাকে যে কোনো ব্যক্তির মূল্যবোধ বর্তমানে তার কার্যকারিতা বা উপযোগিতা থেকে আবির্ভূত হয়, তাহলে, বিশ্বাস করুন, সে হিটলারের কর্মসূচি অনুযায়ী ইউথেনেইযিয়া বা যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর জন্য অনুনয় না করার জন্য ব্যক্তিগত অসঙ্গতির কাছে ঋণী, তা বলতে হলে, যারা সামাজিক উপযোগীতা বা কার্যকারিতা হারিয়েছে তাদের “করুণা” মৃত্যু বা  বিনা যন্ত্রণায় মৃত্যু, হতে পারে বৃদ্ধ বয়সের দরুন, দুরারোগ্য অসুস্থতা, মানসিক অবক্ষয়, অথবা যে কোনো শারীরিক অক্ষমতা। 

মানুষের মর্যাদাকে উপযোগিতা বা কার্যকারিতার সাথে বিভ্রান্ত করা ধারণাগত বিভ্রান্তি থেকে সৃষ্টি হয় যাকে পালাক্রমে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর অনেক বিশ্লেষণনির্ভর শয্যায় সঞ্চারিত হওয়া সমসাময়িক নাস্তিবাদে সনাক্ত করা যেতে পারে। এমনকি প্রশিক্ষণ বিশ্লেষণের পারিপার্শ্বিকতায় এরকম এক অনুশাসন সংঘটিত হতে পারে। নাস্তিবাদ কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নাই বলে বিতর্ক করে না, বরং তা সবকিছুকেই অর্থহীন বলে মতামত দেয়। এবং “বিজ্ঞ অর্থহীনতা”র কথা প্রচারের সময় জর্জ এ. সার্জেন্ট ঠিকই বেলছিলেন। তিনি নিজেও একজন থেরাপিষ্টের কথা স্মরণ করেন যে তাকে বলেছিলেন, “জর্জ, আপনাকে বুঝতে হবে পৃথিবীটায় একটা উপহাস। এখানে কোনো ন্যয়বিচার নাই, সবকিছুই যেন এলোমেলো। কেবল যখনই আপনি তা অনুধাবন করতে পারবেন তখন আপনি বুঝবেন নিজেকে একনিষ্ঠতার সাথে নেওয়াটা কতোটা বোকাটে ব্যাপার। বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নাই। কেবল তাই। আজ আপনি কিভাবে আচরণ করবেন সে সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নেবেন তাতে কোনো বিশেষ অর্থ নেই”।[7]

এরকম এক সমালোচনাকে সাধারণীকরণ করা উচিৎ হবে না। নীতিগতভাবে, প্রশিক্ষণ অপরিহার্য, কিন্তু যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে নৈরাশ্যবাদে সংক্রমিত করার চেয়ে থেরাপিষ্টদের নাস্তিবাদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষাণার্থীদের প্রতিষেধক প্রদানকে তাদের কাজ হিসেবে দেখা উচিৎ যা তাদের নিজস্ব নাস্তিবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিরক্ষা কৌশল।

লগোথেরাপিষ্টরা এমনকি অন্যান্য ধারার সাইকোথেরাপি কর্তৃক নির্ধারিত কিছু প্রশিক্ষণ আর লাইসেন্সিং প্রয়োজনীয়তা মেনে চলতে পারে। অন্য অর্থে, কেউ হয়তো হায়েনার সাথে গর্জন করতে পারে, যদি দরকার পড়ে, কিন্তু তা করার সময় আমি অনুরোধ করবো কাউকে হায়েনার বেশে ভেড়া হওয়ার জন্য। মানুষের মৌলিক ধারনার প্রতি অসত্য হওয়ার কোনো দরকার নেই এবং জীবন দর্শনের নীতি লগোথেরাপিতে অন্তর্নিহিত। এরকম আনুগত্য বজায় রাখার কষ্টসাধ্য নয় কারণ অস্ট্রিয়ার মনঃচিকিৎসক এলিযাবেথ এস. লুকাস বলেন, সাইকোথেরাপির ইতিহাস জুড়ে লগোথিরাপির মতো কোনো ধারা ছিল না”।[8] লগোথেরাপির প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে (স্যান ডিয়েগো, কালিফোর্নিয়া, নভেম্বর, ৬-৮, ১৯৮০) আমি কেবল সাইকোথেরাপির পুণঃমানবিকরণ সম্পর্কে তর্ক করিনি বরং আমি যাকে the degurufication of logotherapy   বা লগোথেরাপির গুরুমুক্তকরণ সম্পর্কেও তর্ক করেছি। আমার আগ্রহ তোতা পাখি বংশবিস্তারে নিহিত নয় যারা “তাদের প্রভুর কথা” অনুশীলন করে, কিন্তু “স্বাধীন আর উদ্ভাবনীশক্তি সম্পন্ন, প্রতিভাবান, আর সৃজনশীলদের কাছে  আলোক মশাল হস্তান্ত করাই আমার আগ্রহ।

সিগমুণ্ড ফ্রয়ড এক সময় জোর দিয়ে বলেছিলেন, “কেউ বেশ কয়েকজন সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় মানুষদের অভিন্নভাবে প্রবল আকাঙ্ক্ষার কাছে প্রকাশ করার প্রচেষ্টা করুক। অপরিহার্য তাড়নার প্রবল আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধির সাথে সাথে সকল স্বতন্ত্র ভিন্নতা মলিন হয়ে যাবে, আর তাদের বদলে অশান্ত অভিলাষের অভিন্ন অভিব্যক্তি প্রকাশিত হবে”। ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন, সিগমুণ্ড ফ্রয়ড বন্দী শিবিরকে ভেতর থেকে বুঝতে পারেন নি। তার রোগীরা ভিক্টোরিয়ান সংস্কৃতির ধারায় আড়ম্বরপূর্ণভাবে সজ্জিত পালঙ্কে শুয়ে থাকতো, আশউইৎযের নোংরায় নয়। সেখানে “স্বতন্ত্র ভিন্নতা” “মলিন” হয়নি তবে, তার বিপরীতে, মানুষ আরও অধিক হারে বৈচিত্র হয়ে উঠেছিল; লোকেরা নিজেদের মুখোশ উন্মোচন করেছিল, শুকর আর সাধু উভয়েই। আর আজকে আপনাকে সেইন্ট বা “সাধু” শব্দটি ব্যবহার করতে ‍দ্বিধাবোধের দরকার নেই: পোল্যাণ্ডের সাধু ম্যক্সিমিলিয়ান কলবে’র কথা ভাবুন যাকে অনাহারে রাখা হয়েছিল আর অবশেষে আশউইৎযের শিবিরে কার্বোলিক এসিড ইঞ্জেকশন দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল আর যাকে ১৯৮৩ সালে সেইন্ট বা সাধু উপাধিতে ভুষিত করা হয়েছিল।

নিয়ম নিয়মবহির্ভূত উদাহরণ আনার কারণে, আপনার হয়তো আমাকে দোষারোপ করার প্রবণতা থাকতে পারে। ‍স্পিনোযার নীতিশাস্ত্র মতে, “but everything great is just as difficult to realize as it is rare to find” (কিন্তু প্রতিটি মহান জিনিস খুজে পাওয়া যেমন দুষ্কর তেমনি অনুধাবন করাও কঠিন)। আপনি অবশ্য প্রশ্ন করতে পারেন “সাধু’র প্রতি নির্দেশ আদৌ দরকার ছিল কিনা। মানুষ হিসেবে নির্দেশ করাই কি যতেষ্ট হতো না? এটা সত্যি যে তারা সংখ্যালঘু মানুষ। তারচেয়েও, তারা সবসময়ই সংখ্যালঘু হিসেবে রয়ে যাবে। আর তবুও আমি সেই সংখ্যালঘুতে যোগ দেওয়াকে বড় প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখি। কারণ পৃথিবী মন্দ অবস্থায়, কিন্তু সব কিছু আরও মন্দ হয়ে উঠবে যদি না আমরা প্রত্যেকে সর্বোত্তম কাজটি করি।

তাই, আসুন সচেতন হয়-দ্বিমুখীভাবে সচেতন:
অশউইৎযের পর থেকে আমরা জানি মানুষের পক্ষে কি করা সম্ভব।
আর হিরোশীমার পর থেকে জানি কি ঝুঁকিতে রয়েছে।


[1] W. H. Sledge, J. A. Boydstun and A. J. Rabe, “Self-Concept Changes Related to War Captivity,” Arch. Gen. Psychiatry, 37 (1980), pp. 430-443. 8

[2] “মানবাত্মার অদম্য শক্তি” বা The Defiant Power of the Human Spirit” ছিল ন ১৯৮৩’তে বিশ্ব তৃতীয় লগোথেরাপি সম্মেলন কর্তৃক উপস্থাপিত গবেষনার শিরোনাম । 

[3] পোল্যান্ডের এক কার্ডিওলজিষ্ট এর দেওয়া অস্ট্রিয়ান টেলিভিশনে শুনা এক সাক্ষাৎকারের কথা আমি ভুলতে পারবো না, যিনি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ওয়ারসো বস্তি বিদ্রোহ সংঘটিত করতে সাহায্য করেছিলেন। “কী বীরত্বপূর্ণ কাজ” তিনি বিস্ময়ে প্রতিবেদক বলেন। “শুনেন”, শান্তভাবে ডাক্তার সাহেব উত্তর দিলেন, “গুলি হাতে নেওয়া আর গুলি ছুড়া কোনো মহান জিনিস নয়; কিন্তু যদি SS সদস্যরা তোমাদের গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যায় বা নিয়ে যায় কোনো গণ কবরে তোমাদের প্রাণ নাশের জন্য, আর তাতে আত্ম-মর্যাদার সাথে পথ অনুসরণ করা ছাড়া তোমাদের করার কিছুই থাকে না, দেখো, আমি তাকেই বীরত্ব বলি”। মনোভাবগত বীরত্ব, বলতে গেলে।

[4] আরও দেখুন Joseph B. Fabry, The Pursuit of Meaning, New York, Harper and Row, 1980.

[5] Cf. Viktor E. Frankl, The Unheard Cry for Meaning, New York, Simon and Schuster, 1978, pp. 42-43.

[6] আরও দেখুন Viktor E. Frankl, Psychotherapy and Existentialism, New York, Simon and Schuster, 1967.

[7] “Transference and Countertransference in Logotherapy,” The International Forum for Logotherapy, Vol. 5, No. 2 (Fall/Winter 1982), pp. 115-18.

[8] লগোথেরাপিকে সাইকোথেরাপিতে আগ্রহীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না। এটি প্রাচ্যের বাজারের সাথে তুল্য নয় বরং এটিকে এক সুপার মার্কেটেরে সাথে তুলনা করা যায়। বাজারের বেলায় ক্রেতাকে কোনো কিছুর কেনার জন্য প্ররোচিত করতে হয়। সুপার মার্কেটের বেলায় ক্রেতাকে ভিবিন্ন জিনিস দেখানো হয়, এবং প্রস্তাব করা হয় যেখান থেকে সে যেটাকে ব্যবহারযোগ্য আর মূল্যবান মনে করে সেটাই বেছে নেবে।

লেখক পরিচিতি

Victor Frankl, Author of Man's Search for meaning
Victor Frankl

ভিক্টর ফ্রাঙ্কল ছিলেন ইউনিভার্সিটি অভ ভিয়েনা মেডিকেল স্কুল এর স্নায়ু-তত্ত্ব ও মনোচিকিৎসার প্রফেসর এবং ইউনাইটেড স্টেইট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির লগোথেরাপির বিশিষ্ট প্রফেসর। তিনি হলেন তৃতীয় ভিয়েনিস স্কুল অব সাইকোথেরাপি’র স্কুল অভ লগোথেরাপির প্রতিষ্ঠাতা (ফ্রয়ডের psychoanalysis এবং এডলারের individual psychology বা স্বতন্ত্র মনস্তত্ত্বের পর)। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে, ড. ফ্রাঙ্কল ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অভ মেডিসিন ও ডক্টর অভ ফিলসফি লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় তিনি তিন বছর অশউইৎযের, ডাক্সাও এবং অন্যান্য বন্দী শিবিরে কাটান। ড. ফ্রাঙ্কল ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে INTERNATIONAL JOURNAL OF PSYCHOANALYSIS এ প্রথম প্রকাশ করেছিলেন এবং তখন থেকে তিনি সাতাশটি বই প্রকাশ করেন যা জাপানি ও চীনা ভাষা সহ অন্যান্য ভাষায় অনুদিত হয়। তিনি ছিলেন হার্ভার্ড, প্যান্সিলভানিয়া ডুকেইন বিশ্ববিদ্যালয় ও সাউদার্ন মেথোডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর। শিকাগোর লয়োলা বিশ্ববিদ্যালয়, এজক্লিফ কলেজ, রকফোর্ড ও মাউন্ট মেরি কলেজ সহ ব্রাজিল, ভেনেযোয়েইলা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ থেকে তাকে অনারারী ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন এক আমন্ত্রিত ল্যাকচারার এবং কেবল যুক্তরাষ্ট্রতেই তিনি বায়ান্ন-বার ল্যাকচার সম্পর্কিত ভ্রমণ করেন। তিনি ছিলেন অস্ট্রিয়ান মেডিকেল সোসাইটি অভ সাইকোথেরাপির প্রেসিডেন্ট ও অস্ট্রিয়ান একাডেমী অব সায়েন্সের অনারারী সদস্য।

সমাপ্ত

০৩/০১/২০২৩, প্রবীণ।

Romzanul Islam

Thinking out of the convention and moving forward with knowledge and reasons are always my styles. Researching, watching the best films, and reading and collecting the best books to enrich me is my deadly passion. Stoicism, liberalism, feminism and aversion to material success are my ideals.