man's search for meaning Bangla translation

Man’s Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023

  • Post author:
  • Post last modified:24 January 2024

Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm

ভয়ে ভয়ে পালের মাঝখানে ভীড় করা ভেড়ার মতো, আমরা প্রত্যেকেই সব সময় আমাদের পালের কেন্দবিন্দুতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলাম। তাতে আমরা আমাদের সারির সামনে-পেছনে ধাবমান প্রহরীদের বেতের আঘাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম। আর পালের ঠিক মাঝখানে অবস্থান করার ফলে ঠান্ডা বাতাস থেকে সুরক্ষার বাড়তি এক সুবিধাও ছিল। সুতরাং, নিজের জান বাঁচানোর চেষ্টায় একজন মানুষ আক্ষরিকভাবে ভিড়ের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। যে কাজটি পালের মধ্যে আপনা-আপনিতেই ঘটে থাকতো। কিন্তু মাঝে মাঝে SS কর্মীদের দৃষ্টি এড়াতে তা ছিল শিবিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আত্ম-রক্ষার উপায়। আমাদের পক্ষ থেকে তা ছিল একটি খুবই সচেতন প্রচেষ্টা। আমরা সব সময় SS কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেছিলাম।

*******

অবশ্য সম্ভব হলে এবং এমনকি প্রয়োজনে ভিড় থেকে নিজেদের দুরে রাখার সময়ও আমাদের ছিল। একটি বিষয় সবার জানা আছে যে চাপিয়ে দেওয়া কোনো সমাজ-জীবনে সব সময় একজন মানুষ যা করে তার দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়। যা একজন মানুষকে অন্তত অল্প সময়ের জন্য হলেও তা থেকে নিস্তার পাওয়ার এক অনিবার্য তাড়নার সৃষ্টি করতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে একজন কয়েদি নিজের সাথে এবং তার ভাবনা নিয়ে একা থাকাকে ব্যাকুলভাবে কামনা করে। সে একটু গোপনীয়তা আর নির্জনতার জন্য আকুল হয়ে উঠে। তথাকথিত একটি “বিশ্রাম শিবির”এ আমার অপসারণের পর একবার প্রায় পাঁচ মিনিটের জন্য একাকী থাকার  দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল আমার। মাটির যে ছাউনিটির পেছনে আমি কাজ করেছিলাম ও যাতে প্রায় পঞ্চাশ-জন বিকারগ্রস্ত রোগী ভিড় করছিল সেখানে ক্যাম্পকে ঘেরা কাঁটাতারের জোড়া বেড়ার এক কোনায় একটি কোলাহল-মুক্ত স্থান ছিল। কয়েকটি খুঁটি আর গাছের ঢাল দিয়ে সেখানে একটি তাম্বুর বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, যাতে পাঁচ-ছয়জন রোগীকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া যায়। ক্যাম্পে প্রতিদিন পাঁচ-ছয়জন মানুষ মারা যেতো। একটি খাদ পানির পাইপের দিকে বয়ে গিয়েছিল। যখনই হাতে কোনো কাজ থাকত না, তখন আমি গিয়ে পানির খাদের কাঠের তৈরি ঢাকনায় উবু হয়ে বসে থাকতাম। আমি কেবল বসে থাকতাম আর প্রস্ফুটিত সবুজ ঢালু আর দুরের কাঁটাতারের বুননে আবৃত বাভারিয়ান ভূপৃষ্ঠের পর্বত সমূহের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতাম, আর আমার ভাবনাগুলি উত্তর থেকে উত্তরপূর্ব দিকে, আমার বাড়ির দিকে, ভেসে চলে যেতো। কিন্তু আমি মেঘ ছাড়া কিছুই দেখতে পেতাম না।

আমার পাশে পড়ে থাকা লাশগুলিতে উকুন হামাগুড়ি দিচ্ছিল। তারা আমাকে বিরক্ত করেনি। কেবল পাশ দিয়ে হেটে চলা প্রহরীদের পায়ের শব্দই আমার স্বপ্নভঙ্গ করতে পারতো। অথবা তা হতো রোগীদের কক্ষ থেকে ভেসে আসা ডাক বা হতে পারে আমার ছাউনির জন্য আগত ঔষধ সংগ্রহ করার আহ্বান। ঔষধের মধ্যে থাকতো পঞ্চাশ-জন রোগীর কয়েক দিনের জন্য পাঁচটি বা দশটি এসপ্রিন ট্যাবলেট, যার সরবরাহ সংগ্রহ করার ডাক আমাকে স্বপ্ন থেকে জাগ্রত করেছিল। ঔষধগুলি সংগ্রহ করে রোগীদের শীরা নির্ণয় করে এবং মারাত্মক কোনো অবস্থায় সেবনের জন্য অর্ধেক ট্যাবলেট দেওয়ার পর আমি আমার দায়িত্বের পালা সম্পূর্ণ করেছিলাম। হলে হবে কি, বেপরোয়াভাবে অসুস্থ মানুষেরা কোনো ঔষধ পেত না। কারণ এরকম পরিস্থিতিতে ঔষধে কোনো কাজ হবে না। পাশাপাশি তা যাদের নিয়ে এখনও আশা রয়েছে এমন রোগীদের ঔষধ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে। হালকাভাবে অসুস্থ রোগীদের জন্য উৎসাহের বাক্য ব্যতীত আমার আর কিছুই ছিল না। এভাবে আমি নিজেকে এক রুগী থেকে অন্য রুগীর কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম, যদিও টাইফাসের আক্রমণে আমি নিজেও ছিলাম দুর্বল আর ক্লান্ত। তারপর পানির খাদের কাঠের ঢাকনার কাছে একাকী স্থানে ফিরে যায়।

ঘটনাক্রমে এই খাদটিই এক সময় তিনজন কয়েদির জীবন বাঁচিয়েছিল। আমাদের মুক্তির কিছু দিন আগে ডাক্সাও যাওয়ার জন্য এক গণ-পরিবহনের আয়োজন করা হচ্ছিল। আর এই তিনজন কয়েদি বুদ্ধিমত্তার সাথে যাত্রাটি এড়িয়ে যাওয়া চেষ্টা করেছিল। তারা পানির খাদ বেয়ে উঠে সেখানে প্রহরীদের কাছ থেকে লুকিয়ে থেকেছিল। আমি ঢাকনার উপর শান্তভাবে বসে নিষ্পাপ চেহারা করে কাঁটাতারের দিকে পাথর ছুড়ে বাচ্চাদের মতো খেলা করছিলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে প্রহরীটি এক মুহূর্ত ইতস্তত বোধ করল, কিন্তু তারপর পাশ কেটে চলে গেলো। শীঘ্রই আমি খাদের নিচে সে তিনজন মানুষের চরম বিপদটি কেটে যাওয়া বুঝতে পারি।

শিবিরে মানুষের জীবনের উপর কতো তুচ্ছ মূল্য নির্ধারণ করা হতো তা অনুধাবন করা একজন বহিরাগত মানুষের পক্ষে খুবই কষ্টকর। শিবিরে কয়েদিদের অন্তরকে কঠোর করে তুলা হয়েছিল। কিন্তু  যখন অসুস্থ লোকদের জন্য কোনো বহর বা কনভয়ের আয়োজন করা হতো তখন মানব জীবনের এই তাচ্ছিল্যতা সম্পর্কে তারা আরও সচেতন হয়ে উঠতো। অসুস্থদের ক্ষীণকায় দেহগুলি কয়েদিদের দিয়ে মাইলের পর মাইল তুষার ঝড়ের মধ্যে নিকটবর্তী শিবিরে টেনে আনা দুই চাকার টানাগাড়িতে নিক্ষেপ করা হতো। টানাগাড়ি বা কার্ট ত্যাগের আগে যদি কোনো অসুস্থ লোক মারা যেত, অসুস্থ মানুষের সংখ্যার তালিকা ঠিক রাখার জন্য তবুও তাকে সেখানে নিক্ষেপ করা হতো! কারণ এই তালিকাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মানুষ নয়। একজন মানুষকে কেবল তার কয়েদি নাম্বারের জন্যই মূল্যায়ন করা হতো। একজন ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে একটি সংখ্যায় পরিণত হয়েছিল। মৃত বা জীবিত তা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কোনো নাম্বারের জীবন ছিল সম্পূর্ণ অর্থহীন। সেই সংখ্যা আর মানুষটির জীবনকে ঘিরে তার নিয়তি, তার ইতিহাস, আর পরিচিতি ছিল আর কম গুরুত্বপূর্ণ। একজন চিকিৎসক হিসেবে অসুস্থ রোগীদের যে গাড়িতে করে আমাকে ভাবারিয়ার এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে যেতে হয়েছিল, সে গাড়ির লোকদের তালিকার মধ্যে এক যুবক কয়েদির ভাইয়ের নাম ছিলনা বলে তার ভাইকে পেছনে ফেলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুবকটি এত দীর্ঘ সময় ধরে অনুনয়-বিনয় করেছিল যে শিবির ওয়ার্ডেন তার অন্য একজন কয়েদির বদলে তার ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে তার ভাইটিও যুবকটির সাথে যেতে পারে। যার দরুন ভাইটি এমন এক ব্যক্তির স্থান নিয়েছিল যে সে মুহূর্তে শিবিরে থেকে যাওয়াটা শ্রেয় মনে করেছিল। কিন্তু তালিকা তো সঠিক থাকা চায়! সহজেই তা সম্ভব হতো। ভাইটি অন্য বন্দীর নাম্বারের সাথে তার নাম্বারটি বদলে নিয়েছিল।

আমি যেমনটি আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের কাছে কোনো ধরনের নথিপত্র ছিল না। তাই প্রত্যেকেই তার নিজের দেহকে অক্ষত রাখতে পারার কারণে সৌভাগ্যবান ছিল, যে দেহটিতে সর্বোপরি তখনও নিঃশ্বাস আসা যাওয়া করছিল। আমাদের সম্পর্কে অবশিষ্ট সবকিছুর প্রতি আগ্রহ তখনই ছিল, যখন অসুস্থ রোগীদের পরিবহনে আমাদের নিযুক্ত করা হয়ে থাকত, তা হতে পারে আমাদের রোগা কঙ্কাল থেকে ঝুলন্ত নেকড়া। ছেড়ে যাওয়ার সময় নির্লজ্জ আগ্রহের সাথে “মুসলেমদের” কোনো কোট বা জুতোজোড়া কারো কারো কোট বা জুতোর চেয়ে ভালো কিনা তা পরখ করে দেখছিল কিছু কিছু মানুষ। সর্বোপরি, তাদের ভাগ্যকে মোহর করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যারা শিবিরে রয়ে গিয়েছিল, যারা তখনও কিছু কাজ করতে সমর্থ ছিল, তাদেরকে বেঁচে থাকার সম্ভাবনার উৎকর্ষ সাধনে প্রতিটি উপায়কে কাজে লাগাতে হয়েছিল। তারা ভাবপ্রবণ ছিলনা। তারা দেখতে পেলো যে তাদের ভাগ্য সম্পূর্ণরূপে প্রহরীদের মন-মেজাজের উপর নির্ভরশীল, যাকে একটি ভাগ্যের ছেলেখেলা বলা চলে। আর তা তাদের পরিস্থিতির দ্বারা আহুত অমানবিকতার চেয়েও বেশি অমানবিক করে তুলেছিল। 

অশউৎয শিবিরে আমি আমার নিজের জন্য একটি নিয়ম বাস্তবায়ন করি যা মঙ্গলজনক নিয়মে পরিণত হয়। এবং যা পরবর্তীতে আমার অধিকাংশ সহ-কর্মী অনুসরণ করেছিল। আমি সাধারণত সব প্রশ্নে উত্তর সততার সাথে দিতাম। কিন্তু স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস না করা কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি নীরব থাকতাম। আমার বয়স জিজ্ঞেস করা হলে আমি তা বলতাম। আমার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে আমি বলতাম আমি একজন “চিকিৎসক”, কিন্তু কি ধরনের চিকিৎসক তা ব্যাখ্যা করতাম না। অশউইৎযের প্রথম সকালে একজন SS কর্মকর্তা মাঠে কুচকাওয়াজ করতে এসেছিলেন। আমাদের কয়েদিদের পৃথক পৃথক সারিতে দাঁড়াতে হয়েছিল: চল্লিশ বছরের ঊর্ধ্বে, চল্লিশ বছরের নীচে, মেটাল শ্রমিক, কারিগর, ও অন্যান্য। তারপর আমাদের দেহের ভেতরে কোনো আঘাত আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিল এবং কয়েকজন বন্দীকে নিয়ে আরেকটি নতুন দল তৈরি করা হয়েছিল। আমি যে দলে ছিলাম সে দলটিকে অন্য একটি ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যেখানে আমরা পুনরায় সারিবদ্ধ হয়েছিলাম। আরও একবার যাচাই-বাছাইয়ের পর ও আমার বয়স আর পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাকে আরেকটি ছোট দলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আরও একবার আমাদের অন্য একটি ছাউনিতে চালিত করে ভিন্নভাবে দলবদ্ধ করা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে কিছু সময় ধরে, আর অবোধ্য বিদেশী ভাষায় কথা বলা অপরিচিতদের মাঝে নিজেকে আবিষ্কারের ফলে আমি কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। তারপর আসে অন্তিম নির্বাচনের পালা, আমি নিজেকে প্রথম ছাউনিতে যে দলটিতে ছিলাম সে দলটিতে নিজেকে পুনরায় খুঁজে পায়! তারা বুঝতে পারেনি যে আমাকে ইতিমধ্যে এক ছাউনি থেকে অন্য ছাউনিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সেই কয়েক মিনিটে আমার নিয়তি আমার কাছে বিভিন্ন রূপে ধরা দিয়েছিল।

যখন “বিশ্রাম শিবিরের” জন্য অসুস্থদের নিয়ে যাওয়ার পরিবহনের আয়োজন করা হচ্ছিল, তখন তালিকায় আমার নাম (আমার নাম্বার বা সংখ্যা) দেওয়া হয়েছিল কারণ সেখানে কয়েকজন চিকিৎসকের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে গাড়িটি আসলেই কোনো বিশ্রাম শিবিরের দিকে যাচ্ছিল। কয়েক সপ্তাহ আগেও সেই একই পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তখনও সবাই ভেবে নিয়েছিল যে গাড়িটি গ্যাস চুল্লির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু যখন ঘোষণা করা হলো যে, যারা ভয়াবহ রাতের শিফটে রোগীদের স্বেচ্ছাসেবা প্রদান করবে তাদের নাম পরিবহনের জন্য প্রস্তুত তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে, সঙ্গে সঙ্গে বিরাশি জন কয়েদি স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিল। পনের মিনিট খানেক পর পরিবহনটি বাতিল করা হলেও রাতের শিফটের জন্য বিরাশি জনের নাম তালিকায় রয়েই গেল। অনেকের কাছে তা ছিল পরবর্তী পনের দিনের মধ্যে মৃত্যু।

এখন পুনরায়  বিশ্রামে ক্যাম্পের জন্য দ্বিতীয় বারের মতো পরিবহনের ব্যবস্থা করো হলো। আবারও কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে অসুস্থদের কাছ থেকে চৌদ্দ দিনের জন্য কাজ আদায়ের শেষ কামড় ছিল কিনা—বা গ্যাস চুল্লিতে যাবে কি না, অথবা যাবে কিনা প্রকৃত বিশ্রাম শিবিরে। প্রধান চিকিৎসক, যিনি আমাকে পছন্দ করতেন, এক সন্ধ্যায় পৌনে দশটার দিকে চুপেচুপে আমাকে বলেছিলেন, “কর্তব্যরত কক্ষে আমি জানিয়ে দিয়েছি যে তুমি চাইলে তালিকা থেকে তোমার নাম মুছে ফেলতে পারবে; তুমি দশটা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তা করতে পারো”।

আমি তাকে বললাম যে এটা আমার কাজ নয়; নিয়তি আমাকে যে দিকে নিয়ে যায় সেদিকে আমি চলতে শিখেছি। “আমিও সম্ভব আমার বন্ধুদের সাথে থাকতে চাই”, আমি বললাম। তার চোখে আমি কৃপার দৃষ্টি লক্ষ করি, মনে হলো যেন তিনি তা জানতেন….। তিনি নীরবে আমার সাথে করমর্দন করেন, মনে হলো যেন বিদায় জানাচ্ছেন, আজীবনের জন্য নয়, বরং জীবন থেকে বিদায় জানাচ্ছেন। ধীরে ধীরে আমি আমার ছাউনির দিকে হেটে যায়। গিয়ে দেখি সেখানে আমার এক ভালো বন্ধু আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

“তুমি কি আসলে তাদের সাথে যেতে চাও”? সে জিজ্ঞেস করেছিল।

“ হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি”।

তার চোখে পানি আসলো আর আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছিলাম। তার কাছে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেওয়া বাকি ছিল-

“শুনো, ওটো, আমি যদি আমার স্ত্রীর কাছে ফিরে নাও যাই, ও তার সাথে যদি তোমার পুনরায় দেখা হয়, তাহলে তাকে বলো যে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আমি তাকে স্মরণ করছিলাম। তোমার মনে আছে নিশ্চয়। দ্বিতীয়ত, যে কারো চেয়েও বেশি আমি তাকে ভালবেসেছিলাম। তৃতীয়ত, যে সংক্ষিপ্ত সময়টিতে আমি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থেকেছি তা এখানে আমি যা কিছুর মধ্য দিয়ে গিয়েছি তার সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে”।

ওটো, তুমি এখন কোথায়? তুমি কি বেঁচে আছো? শেষবার যখন দু’জন একসঙ্গে হয়েছিলাম তখন থেকে তোমার কি হয়েছে? তুমি কি আবার তোমার স্ত্রীকে খুঁজে পেয়েছ? তোমার কি মনে আছে তোমার শিশুসুলভ কান্না সত্ত্বেও আমি কিভাবে তোমাকে আমার ইচ্ছা মুখস্থ করিয়েছিলাম?

পরদিন সকালে আমি পরিবহনের সাথে চলে গিয়েছিলাম। এবার তা কোনো গুজব ছিল না। গ্যাস চেম্বারে না গিয়ে আমরা এক বিশ্রাম শিবির দিকে ধাবিত হচ্ছিলাম। যারা আমাকে দয়া দেখিয়েছিল তারা শিবিরে রয়ে গিয়েছিল। আমাদের চলে যাওয়ার পর সে শিবিরে এক দুর্ভিক্ষ আমাদের নতুন শিবিরের চেয়ে মারাত্মকভাবে তাণ্ডব চালিয়েছিল। তারা নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করলেও তাদের নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মাস পর, আমাদের মুক্তি পর অশউইৎযের পুরনো শিবিরের এক বন্ধুর সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল। একজন শিবিরের একজন সে পুলিশ হিসেবে সে আমাকে বলেছিল যে, সে লাশের স্তূপ থেকে হারিয়ে যাওয়া সে একটুকরো মানব দেহের খুঁজ করেছিল। সে মানব দেহটি একটি পাত্রের ভেতরে রান্না করা অবস্থায় খুঁজে পেয়ে জব্দ করে। নরমাংস খাওয়া ছড়িয়ে পড়েছিলো শিবিরে। ভাগ্যিস আমি ঠিক সময়েই শিবির ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম।

এটি কি আপনাকে Death in Teheran বা তেহরানে মৃত্যু গল্পটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না? পারস্যের এক ধনী ও শক্তিশালী লোক একদা তার দাস-দাসীদের সঙ্গে নিয়ে তার বাগানে পায়চারি করছিলেন। এক দাস চিৎকার করে বলে উঠে যে সে এইমাত্র মৃত্যুর সাথে মুখোমুখি হয়েছিল, যে তাকে হুমকি দেয়। তাই সে তার প্রভুকে অনুনয় করে তার সবচেয়ে দ্রুততম ঘোড়াটি তাকে দেওয়ার অনুরোধ করে যাতে সে দ্রুত তেহরানে পালিয়ে যেতে পারে, যেখানে সে সন্ধ্যায় পৌঁছাতে পারতো। প্রভু রাজি হলেন আর দাসটি ঘোড়ার পিটে রওয়ানা করে। বাড়িতে ফেরার পথে প্রভু নিজেই মৃত্যুর সাথে সাক্ষাৎ করে, এবং মৃত্যুকে প্রশ্ন করে, “আপনি কেন আমার দাসকে আতঙ্কিত ও হুমকি দিয়েছেন?” “আমি তাকে হুমকি দেয়নি; আমি কেবল তাকে এখানে খুঁজে পেয়ে তার কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলাম। আজ রাতেই তেহরানে তার সাথে সাক্ষাতের পরিকল্পনা করেছি”, মৃত্যু বলল।

*******

শিবিরের কয়েদিরা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। নিয়তি যে কারো জীবনের নিয়ন্ত্রক হতে পারে তা তারই শক্তিশালী ফলাফল। তারা চিন্তা করতো নিয়তিকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করা উচিৎ নয়। নিয়তিকে বরং এর নিজের গতিতেই চলতে দেওয়া উচিৎ। অধিকন্তু, উদাসীনতাও কয়েদিদের অনুভূতিতে এক বড় প্রভাব ফেলতো। অনেক সময়, জীবন-মৃত্যুর কারণ হতে পারে এমন তড়িৎ সিদ্ধান্ত তাদের গ্রহণ করতে হতো। নিয়তিকে তাদের হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাকে কয়েদিরা শ্রেয় মনে করতো। বন্দীদশার এই গৃহীত দায়িত্ব থেকে রেহায়ের এই উপায় শিবির থেকে কোনও কয়েদির পালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার পক্ষে-বিপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হতো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সে মিনিটগুলিতে সে নরকের যন্ত্রণা ভোগ করতো। তার কি পালিয়ের যাওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ? ঝুঁকিটা নেওয়া কি তার উচিৎ হবে?   

আমিও এ যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। যুদ্ধক্ষেত্র যতই নিকটে আসতে থাকে, ততই আমার পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ আসে। আমার এক বন্ধুকে চিকিৎসা দায়িত্বের খাতিরে শিবিরের বাইরে ছাউনিতে পরিদর্শনে যেতে হতো, সেও পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। আর চেয়েছিল আমাকেও সঙ্গে নিতে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন এমন এক রোগীকে পরামর্শ দানের ভান করে সে বাইরে বেরিয়ে পড়েছিল একদিন। শিবিরের বাইরে এক বিদেশী প্রতিরোধ আন্দোলন কর্মীর আমাদের উর্দি ও প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র সরবরাহ করার কথা ছিল। ঠিক সে মুহূর্তে শিবিরে কিছু কারিগরি জটিলতা দেখা দেয়ার কারণে আমাদের পুনরায়  শিবিরে ফিরে যেতে হয়েছিল। সুযোগটিকে আমরা কিছু খাদ্য সংগ্রহ—কয়েকটি পচা আলু—এবং কাঁদ ব্যাগ খুঁজার জন্য ব্যবহার করি।

আমরা মহিলাদের একটি খালি ছাউনিতে দরজার ভেঙ্গে ডুকে পড়েছিলাম। মহিলাদের অন্য শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়াই ছাউনিটি খালিই পড়েছিল। ছাউনিটি খুবই বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল; দেখে বোঝা-ই যাচ্ছিল যে অনেক মহিলা জোগান সংগ্রহ করে পালিয়েছে। নেকড়া, স্ট্র, পচা খাবার, ভাঙ্গা হাড়ি-পাতিলে সয়লাব ছিল ছাউনিটি। কয়েকটি বাটির অবস্থা তখনও ভালো ছিল, যা আমাদের কাছে মূল্যবান মনে হলেও না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ আমরা জানতাম যে সম্প্রতি সেগুলি কেবল খাবারের জন্য ব্যবহার করা হয়নি, বরং তা হাত-ধোয়ার বেসিন ও মূত্রাধার বা মূত্রধানী হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। ছাউনিতে কোনো ধরনের বাসনকোসন আনার বিরুদ্ধে কঠোর আইন ছিল। যদিও কাউকে কাউকে এই বিধিনিষেধ ভাঙ্গতে বাধ্য করা হয়েছিল, বিশেষত টাইফাস রোগীর ক্ষেত্রে। টাইফাস রোগীরা এতই দুর্বল ছিল যে অন্যদের সাহায্য নিয়েও বাইরে বের হতে পারত না।  আমি যখন পাহারাদার হিসেবে কাজ করছিলাম তখন আমার বন্ধুটি ভেতরে ডুকেই অল্প সময়ের মধ্যে তার কোটের ভেতর লুকিয়ে একটি কাঁদ-ব্যাগ নিয়ে ফিরে আসল। সে ভেতরে আরও একটি কাঁদ-ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখে তা আমাকে সংগ্রহ করতে বলেছিল। তাই আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করে আমি ভেতর ডুকে পড়ে ছিলাম। আবর্জনার মধ্যে খুঁজ করার সময় আমি যে শুধু কাঁদ-ব্যাগ আর দাঁত মাজার ব্রাশ খুঁজে পেয়েছিলাম তা নয়, অন্যান্য জিনিসের মাঝে আমি হঠাৎ ফেলে যাওয়া একটি বস্তুর দিকে লক্ষ্য করি, তা ছিল এক নারী দেহ।

আমি দৌড়ে আমার জিনিসপত্র সংগ্রহ করার জন্য আমার ছাউনিতে ফিরে যায়। আমার খাবার বাটি, এক মৃত টাইফাস রোগীর কাছ পাওয়া একজোড়া চীর্ণ দস্তানা, এবং শর্ট-হ্যান্ড নোট সম্বলিত কয়েকটি কাগজের টুকরো (যাতে, যেমনটি আমি আগে বলেছি, আমি অশউইৎযে হারানো পাণ্ডুলিপিটি পুনর্ঘটন শুরু করেছিলাম) সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। ছাউনির উভয় দিকে গলিত কাঠের তক্তায় গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা আমার রোগীদের দ্রুত এক চক্কর দিলাম। মৃতপ্রায় আমার একমাত্র স্বদেশীকে তার মারাত্মক পরিস্থিতি সত্ত্বেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা ছিল আমার লক্ষ্য। তখনও পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম, কিন্তু আমার কিছুটা বিচলিত আচরণ দেখে আমার সহকর্মীটি বোধহয় ততক্ষণে ধারণা করে ফেলেছিল যে আমার কোনো না কোনো সমস্যা হয়েছে। পরিশ্রান্ত কণ্ঠে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমিও বের হয়ে যাচ্ছো”? আমি তা অস্বীকার করলাম, কিন্তু তার দুঃখিত চাহনি এড়িয়ে চলা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমার রোগীদের দেখাশুনা করার পালা শেষ হওয়ার পর আমি তার কাছে ফিরে যায়। পুনরায়  তার নিরাশ চাহনি আমাকে সম্ভাষণ জানায় এবং কোনো না কোনো ভাবে তা আমার কাছে এক অভিযোগর চাহনি বলে মনে হয়েছিল। আমি যে তার সাথে পালিয়ে যাবো তা আমার বন্ধুকে বলা সাথে সাথে যে অপ্রীতিকর অনুভূতি আমাকে ঘিরে ধরেছিল তা আরও প্রগাড় হয়ে উঠেছিল সে মুহূর্তে। হঠাৎ একবারের জন্য হলেও আমার ভাগ্য আমার নিজের হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি দৌড়ে ছাউনি থেকে বের হয়ে গেলাম এবং আমার বন্ধুকে বললাম যে আমি তার সাথে যেতে পারব না। যখনই চূড়ান্তভাবে তাকে বললাম যে আমি আমার রোগীদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অপ্রীতিকর অনুভূতি আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি জানতাম না পরের দিন আমার জন্য কি রয়েছে, কিন্তু আমার ভেতরে আমি এক আভ্যন্তরীণ প্রশান্তি লাভ করেছিলাম যার অভিজ্ঞতা আমি এর পূর্বে আমি কখনও লাভ করিনি। ছাউনিতে ফিরে গিয়ে আমার স্বদেশীর পায়ের কাছে তক্তায় বসে পড়ি এবং তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি; তারপর অন্যদের সাথে আলাপ করেছি, এবং প্রলাপ বিকারে মধ্যে তাদের শান্ত করতে চেষ্টা করেছিলাম।

শিবিরে আমাদের শেষদিন আসে। যুদ্ধক্ষেত্র নিকটে আসলে, গণ-পরিবহন সমূহ প্রায় সব বন্দীদের অন্যান্য শিবিরে নিয়ে যায়। সব শিবির কর্তৃপক্ষ, ক্যাপু ও রাঁধুনিরা পালিয়ে গিয়েছিল। সে দিন এক আদেশ জারি করা হয়েছিল যে, সূর্যাস্তের মধ্যে অবশ্যই শিবির খালি করে দিতে হবে। এমনকি কয়েকজন অবশিষ্ট অসুস্থ ব্যক্তি, কয়েকজন চিকিৎসক, ও কয়েকজন নার্স সহ সব কয়েদিদের চলে যেতে হবে। রাতে শিবিরে আগুন দেওয়ার কথা। বিকেলে যে ট্রাকগুলির রোগীর সংগ্রহ করার কথা ছিল তা তখনও এসে পৌঁছায়নি। বরং ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারগুলি হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং কাঁটাতারের বেড়ার দিকে নিবিড় নজর রাখা হলো যাতে কেউ পালানোর চেষ্টা না করে। মনে হচ্ছিল যেন অবশিষ্ট কয়েদিদের শিবিরের সাথে আগুনে জ্বলতে হবে। আমি ও আমার বন্ধুটি দ্বিতীয় বারের মতো পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

Romzanul Islam

Thinking out of the convention and moving forward with knowledge and reasons are always my styles. Researching, watching the best films, and reading and collecting the best books to enrich me is my deadly passion. Stoicism, liberalism, feminism and aversion to material success are my ideals.