man's search for meaning Bangla translation

Man’s Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023

  • Post author:
  • Post last modified:24 January 2024

Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm

সম্ভবত আমাদের কারো কারো জন্যে কোনো একদিন সে চলচ্চিত্রটি পুনরায় দেখার বা একই ধরনের অন্য কোন ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে হয়তো অন্যান্য চলচ্চিত্রও কারও আভ্যন্তরীণ দৃষ্টির সামনে একই সময়ে উদ্ঘাটিত হয়ে পড়েছিল। কোনো আবেগপ্রবণ চলচ্চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম এমন আবেগের চেয়ে, যেসব মানুষ তাদের জীবনে অনেক বেশি কিছু অর্জন করেছিল তাদের সম্পর্কে চলচ্চিত্র। বন্দী শিবিরে আমার স্বচক্ষে দেখা এক যুবতী মহিলার মৃত্যুর কাহিনীর ন্যায় কোনো ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ মহত্ত্ব সম্পর্কে কিছু বিশদ বিবরণ হয়তো কারো মনে পড়ে যেতে পারে। এটি এক সাধারণ কাহিনী। এ সম্পর্কে তেমন কিছু বলার নেই আর মনে হবে যেন তা আমি উদ্ভাবন করেছি; তবে আমার কাছে তা একটি কবিতার মতো।

এই যুবতী মহিলা জানত পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে সে মারা যাবে। কিন্তু আমি যখন তার সাথে কথা বলি তখন বুঝতে পারি যে, তা জানা সত্ত্বেও উৎফুল্ল ছিল। “আমি কৃতজ্ঞ যে নিয়তি আমাকে এত কঠোরভাবে আঘাত করেছে”, সে আমাকে বলেছিল। “আমার অতীত জীবনে আমি পথ-ভ্রষ্ট ছিলাম এবং আধ্যাত্মিক অর্জনকে আমি গুরুত্বতার সাথে দেখেনি”। ছাউনির জানালা দিয়ে ইশারা করে সে বলেছিল, “এই বৃক্ষটিই আমার একাকীত্বের একমাত্র বন্ধু”। সেই জানালার ভেতর দিয়ে সে কাঠবাদাম গাছটির একটি শাখা দেখতে পেতো, আর সে শাখায় ছিল দুটি ফুল। “আমি প্রায়শই এই বৃক্ষটির সাথে কথা বলি”, সে আমাকে বলেছিল। আমি হতবাক হয়ে পড়লাম ও কিভাবে তার কথাগুলি গ্রহণ করবো তা বুঝতে পারছিলাম না। সে কি তাহলে বিকারগ্রস্ত বা উন্মত্ত ছিল? তার কি মাঝে মাঝে দৃষ্টিভ্রম হতো? উদ্বেগের সাথে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম বৃক্ষটি সাড়া দেয় কিনা। “হ্যাঁ” সে বলেছিল। বৃক্ষটি তাকে কি বলেছিল? “বৃক্ষটি আমাকে বলেছে, আমি এখানে আছি, আমি এখানে, আমি জীবন, অনন্ত জীবন”, সে উত্তর দিয়েছিল।

**********

আমরা আগেই বলেছি যে, বন্দীদের আভ্যন্তরীণ সত্তার অবস্থার জন্য চূড়ান্তভাবে মনস্তাত্ত্বিক কারণকে তেমনটা দায়ী করা যাবে না, যতটা না আমাদের স্বাধীন সিদ্ধান্তের ফলাফল তার জন্য দায়ী। কয়েদিদের উপর করা এক মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা প্রমাণ করে যে, যারা তাদের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক সত্ত্বার উপর “আভ্যন্তরীণ দুর্গকে” (inner hold) প্রশমিত হতে দিয়েছিল কেবল তারাই অবশেষে শিবিরের অবক্ষয়জনিত প্রভাবের শিকার হয়েছিল। এখন প্রশ্ন আসে, কিসের উপাদানে এই “আভ্যন্তরীণ দুর্গের” সৃষ্টি হতে পারে বা হওয়া উচিৎ?

অতীতের বন্দীরা তাদের  অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে একমত পোষণ করে বলে যে, একজন কয়েদিকে কতদিন বন্দীদশায় কাটাতে হবে তা জানতে না পারাটাই ছিল শিবিরের সবচেয়ে হতাশাজনক প্রভাব। তাকে অবমুক্তির কোনো তারিখ জানানো হতো না। আমাদের ক্যাম্পে তা নিয়ে কথা বলাটাই ছিল অর্থহীন। প্রকৃত অর্থে, কেবল কারাভোগই যে অনিশ্চিত ছিল তা নয় বরং তা ছিল অসীম। একজন বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক গবেষক নির্ণয় করেছেন যে, বন্দী শিবিরের জীবনকে একটি provisional existence বা “অস্থায়ী অস্তিত্ব” বলা যেতে পারে। আমরা একে সংজ্ঞায়িত করতে যুক্ত করতে পারি “অজানা সময় অবধি অস্থায়ী অস্তিত্ব”।

নতুন আগন্তুকরা সাধারণত শিবিরের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানত না। যারা অন্য শিবির থেকে ফিরে আসতো তারা বাধ্য হয়েই নীরব থাকত, এবং কিছু কিছু শিবির থেকে কেউই আসতত না। শিবিরে প্রবেশের সময় লোকজনের মনে একটি পরিবর্ত অবস্থান নিতো। অনিশ্চয়তার সমাপ্তির সাথে আসে সমাপ্তির অনিশ্চয়তা। কখনও বা আদৌ এই অস্তিত্বের শেষ হবে কিনা তা অনুমান করা ছিল অসম্ভব। 

ল্যাটিন শব্দ finis এর দু’টি অর্থ রয়েছে: শেষ বা সমাপ্তি, এবং পৌঁছানোর কোনো লক্ষ্য। যে ব্যক্তি তার “অস্থায়ী অস্তিত্ব”র সমাপ্তি দেখতে পারেনি তার পক্ষে জীবনের কোনো চূড়ান্ত লক্ষ্যে স্থির হওয়া সম্ভব ছিলনা। স্বাভাবিক জীবনের তুলনায়, সে ভবিষ্যতের জন্য বেঁচে থাকার সমাপ্তি ঘটায়। তাতে, তার অভ্যন্তরীণ জীবনের পুরো অবকাঠামো পরিবর্তিত হয়ে যায়। অবক্ষয়ের চিহ্ন শুরু হয় যা আমরা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে বুঝতে পারি। যেমন, একজন বেকার শ্রমিকও একই রকম অবস্থায় রয়েছে। তার অস্তিত্ব বা জীবন হয়ে উঠেছে অস্থায়ী এবং কোনো এক নির্দিষ্ট অর্থে সে আর ভবিষ্যতের জন্য বাঁচতে পারে না অথবা ভবিষ্যতের কোনো লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারে না। কয়লাখনির বেকার শ্রমিকদের উপর করা গবেষণায় দেখা যায় যে, তারা এক অদ্ভুত ধরনের অভ্যন্তরীণ deformed time বা “বিকৃত সময়” ব্যাধি’তে ভুগে থাকে। যা তাদের বেকারত্ব অবস্থার পরিণতি। বন্দীরাও এই অদ্ভুত “সময় অভিজ্ঞতা” য় ভুগেছিল। শিবিরে, নির্যাতন আর অবসাদে ভর্তি সময়ের ক্ষুদ্র একক ঘণ্টাকে মনে হতো অন্তহীন সময়। সপ্তাহের মতো বৃহত্তর সময়ের একককে মনে হতো যেন খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। কতই না প্যারাডক্সিকল বা স্ববিরোধী ছিল আমাদের “সময় অভিজ্ঞতা”! এ সম্পর্কে আমাদের টমাস ম্যান এর The Magic Mountain এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।তাতে কিছু খুবই স্পষ্ট মনস্তাত্ত্বিক মন্তব্য রয়েছে। ম্যান স্বাস্থ্যনিবাস (sanatorium) এর যে সব রোগীরা তাদের অব্যাহতির তারিখ সম্পর্কে জানতো না এমন যক্ষ্মা রোগীদের মানসিক অবস্থার আধ্যাত্মিক উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, তারাও একই রকম ভবিষ্যৎহীন ও লক্ষ্যহীন এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দিন কাটায়।

একজন কয়েদি আগমনের পর যে নতুন আগতদের দীর্ঘ সারিতে স্টেশন থেকে শিবিরে কুচকাওয়াজ করেছিল, সে পরে আমাকে জানায় যে কুচকাওয়াজ করার সময় তার মনে হয়েছিল যেন সে তার নিজের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। তার কাছে তার জীবনকে একেবারেই ভবিষ্যৎহীন মনে হয়েছিল। সে ভেবেছিল তার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গেছে, যেন তার ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে। জীবনহীনতার এই অনুভুতি অন্যান্য কারণেও তীব্রতর হয়েছিল: সময়ের বেলায় (time), তা ছিল কারাবন্দী সময়ের সীমাহীনতা যা তারা খুব তীব্রভাবে অনুভব করতো। অবস্থানের বেলায় (space), তা ছিল কারাগারের সংকীর্ণ পরিসর। কাঁটাতারের বাইরে যেকোনো কিছুই তাদের কাছে  বিচ্ছিন্ন আর নাগালের বাইরে মনে হত। আর তা কোন না কোনোভাবে অবাস্তব হয়ে উঠেছিল। শিবিরের বাইরের জীবন যাপন একজন মানুষ যতদূর দেখতে পায় তার কাছে তা অনেকটা একজন মৃত মানুষের কাছে আবির্ভূত হওয়ার ন্যায় আবির্ভূত হতো। তার কাছে মতো হতো সে যেন অন্য জগত থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। 

একজন মানুষ, যে নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়না বলে নিজেকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়, সে নিজেকে অতীত ঘটনা প্রবাহের ভাবনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। অন্য এক অর্থে, সমস্ত ভয়াবহতা সত্ত্বেও বর্তমানকে কম বাস্তবিক করে তুলতে কয়েদিদের অতীতের মাঝে ফিরে যাওয়ার প্রবণতার কথা আমরা আগেই বলেছি। কিন্তু বর্তমানকে বঞ্চিত বাস্তবতা করার মাঝে এক বিপদও রয়েছে। শিবির জীবন থেকে ইতিবাচক কিছু সৃষ্টির অনেক সুযোগকে উপেক্ষা করা সহজ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের “অস্থায়ী অস্তিত্ব বা জীবন” যেমন ছিল অবাস্তব, তেমনি তা ছিল কয়েদিদের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এক পর্যায়ে সবকিছুই একপ্রকার অর্থহীন হয়ে উঠেছিল। এ ধরনের লোকজন ভুলে যায় যে, কেবল এরকম  বিশেষ কোনো কঠিন বাহ্যিক পরিস্থিতিই একজন মানুষকে আধ্যাত্মিকভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে বেড়ে উঠার সুযোগ প্রদান করে। শিবিরের অসুবিধা সমূহকে নিজেদের আভ্যন্তরীণ শক্তির পরীক্ষা হিসেবে নেওয়ার পরিবর্তে, তারা তাদের জীবনকে গুরুত্বতার সাথে না নিয়ে পরিণতিহীন কোনো বস্তুর মতো জীবনকে অবহেলা করেছে। চোখ বন্ধ করে অতীতে বাস করাকে তারা শ্রেয় মনে করেছিল। এরকম মানুষের কাছে জীবন হয়ে উঠেছিল অর্থহীন।

স্বভাবতই কেবল কয়েকজন মানুষ-ই মহানতর আধ্যাত্মিক উচ্চতায় পৌছতে সক্ষম ছিল। কিন্তু কয়েকজনকেই তাদের কাছে প্রতীয়মান জাগতিক ব্যর্থতা আর মৃত্যুর মাধ্যমে মানব মহত্ত্ব অর্জনের সম্ভাবনা প্রদান করা হয়েছে। এটি এমন একটি অর্জন যা সাধারণ কোনো পরিস্থিতিতে তারা কখনই অর্জন করতো না। আমাদের মাঝে অন্যান্য সাধারণ এবং দুর্বলচিত্তের মানুষের জন্য জার্মান কূটনৈতিক বিসমার্কের কথাটি বলা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, “জীবন দন্তচিকিৎসকের কাছে যাওয়ার মতো। আপনি সবমসময় ভাবেন যে হয়তো মন্দটা এখনো বাকি আছে, এবং তারপরও ইতিমধ্যে তার সমাপ্ত হয়েছে।” এর পরিবর্তে, আমরা বলতে পারি যে, বন্দী শিবিরের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেছিলো যে, তাদের জীবনের প্রকৃত সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। তবুও, সত্যিকার অর্থে জীবনের সুযোগ আর প্রতিবন্ধকতা উভয়ই সেখানে  ছিল। জীবনকে এক আভ্যন্তরীণ বিজয়ে পরিবর্তন করার মাধ্যমে একজন মানুষ সেইসব অভিজ্ঞতা থেকে বিজয়ের জন্ম দিতে পারে, বা একজন মানুষ প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করতে ও পুরোপুরিভাবে নীরস জীবন-যাপন করতে পারে, যেমনটি অধিকাংশ কয়েদি করেছিলো।

********

শিবিরে সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা বা সাইকোহাইজিনিক বা মানসিক স্বাস্থ্যবিধি পদ্ধতির মাধ্যমে একজন কয়েদির সাইকোপ্যাথলজিক্যাল (বা মানসিক ব্যাধির) প্রভাবকে দমনের যে কোনো প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল তাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে এমন কোনো ভবিষ্যৎ লক্ষ্য প্রদানে মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শক্তি সরবরাহ করা। স্বভাবতেই, কোনো কোনো কয়েদী নিজে নিজেই তার সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। মানুষের একটি বিশেষত্ব হলো সে কেবলমাত্র ভবিষ্যতের পানে চেয়ে বাচতে পারে। আর তার কঠিন অস্তিত্বের মুহূর্তে এটিই তার মুক্তি, যদিও মাঝে মাঝে তাকে কর্মে তার মনকে বাধ্য করাতে হয়।

আমার এক ব্যক্তিগত অবিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। ছেঁড়া জুতো পরার কারণে আমার পায়ে ভয়ানক ক্ষতের সৃষ্টি হওয়ার কারণে ব্যথার ছোড়ে প্রায় অশ্রুসিক্ত অবস্থায় মানুষের দীর্ঘ সারিতে আমাদের কাজের স্থল থেকে শিবির পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার পথ আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছিলাম। পথিমধ্যে খুবই ঠাণ্ডা আর তীব্র হাওয়া আমাদের তাড়িত করেছিল। তখন আমাদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবনে ছোট ছোট অসংখ্য সমস্যা নিয়ে আমি চিন্তা মগ্ন ছিলাম। যেমন, আজ রাতে খাওয়ার জন্য কি থাকতে পারে? একখানা সচেজ যদি বাড়তি বরাদ্দ হিসেবে আসে, একটুকরো রুটি জন্য কি আমার তার বিনিময় করা উচিৎ হবে? পনের দিন আগে গ্রহণ করা বোনাস থেকে বেছে যাওয়া আমার সর্বশেষ সিগারেটটি আমি এক বাটি স্যুপের সাথে বিনিময় করবো? আমার জুতোর ফিতা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া তারের টুকরোটি প্রতিস্থাপনের জন্য কিভাবে আমি একটুকরো তার পেতে পারি? আমার চলতি কাজের আসরে যোগ দেওয়ার জন্য আমি কি ঠিক সময়ে আমাদের কাজের স্থানে পৌঁছাতে পারব, বা আমাকে কি অন্য দলে যোগ দিতে হবে, যাতে থাকতে পারে এক নির্দয় দল-প্রধান? ক্যাপুদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব বজায় রাখতে আমি কি করতে পারি, যারা আমাকে শিবিরে প্রতিদিন ভয়ানকভাবে দীর্ঘ দৌড়ের দায়িত্ব নেওয়ার পরিবর্ত কাজ পেতে সাহায্য করতে পারে? এসব চিন্তা।

প্রতিদিন আর প্রতি ঘণ্টায় এরকম তুচ্ছ বস্তুর বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করা এমন পরিস্থিতির সাথে আমি বিতৃষ্ণা হয়ে উঠেছিলাম। আমি আমার ভাবনাকে অন্য বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশে বাধ্য করেছিলাম। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমি নিজেকে এক আলো-প্রজ্বলিত ও মনোরম লেকচার কক্ষের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমার সামনে আরামদায়ক পরিশোভিত আসনে বসে আছে মনোযোগী দর্শকেরা। তখন আমি বন্দী শিবিরের মনস্তত্ত্বের বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছিলাম! আমাকে নিপীড়ন করা সবকিছুই সেই মুহূর্তে বস্তুগত হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞানের পরোক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে আমি সেসব লক্ষ্য ও বর্ণনা করেছিলাম। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কষ্টকর পরিস্থিতি, মুহূর্তের যন্ত্রণাভোগের ঊর্ধ্বে উঠতে আমি সফল হয়েছিলাম। আর আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে সেসব যন্ত্রনাভোগ যেন ইতিমধ্যেই অতীত হয়ে গেছে। আমি আর আমার যন্ত্রণা উভয়েই আমার করা আকর্ষণীয় মনো-বৈজ্ঞানিক বা psychoscientific গবেষণার অংশে পরিণত হয়। নীতিবিদ্যায় স্পিনোযা কি বলেন? তিনি বলেন- Emotion, which is suffering, ceases to be suffering as soon as we form a clear and precise picture of it. (“যখনই আমরা যন্ত্রনার বিষয়ে পরিষ্কার এবং সুনির্দিষ্ট চিত্র গঠন করি তখন তা আর যন্ত্রণা থাকে না”।)

*******

ভবিষ্যতের উপর আশা হারিয়ে ফেলা কয়েদিদের নিয়তি নির্ধারণ হয়ে যেতো। ভবিষ্যতের উপর তার আশা হারিয়ে কয়েদিরা তাদের আধ্যাত্মিক নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলতো। এভাবে তারা  নিজেদের অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিতো এবং মানসিক ও শারীরিক অবক্ষয়ের বস্তুতে পরিণত হতো। সাধারণত তা হঠাৎ করেই ঘটে থাকতো, কোনো সংকটের রূপে। তার উপসর্গ ক্যাম্পের অভিজ্ঞ কয়েদিদের কাছে পরিচিত ছিল। আমরা সবাই এই মুহূর্তটাকে ভয় পেতাম–নিজেদের জন্য নয়, কারণ নিজেদের জন্য ভয় পাওয়া অর্থহীন। বরং আমরা আমাদের বন্ধুদের জন্যই ভয় পেতাম। সাধারণত তা কোনো এক সকালে কোনো কয়েদির কাপড় পরতে, গোসল করতে বা কুচকাওয়াজ মাঠে যাওয়ার অস্বীকৃতি জানানো থেকে শুরু হত। কোনো অনুনয়-বিনয়, কোনো মারধর, কোনো হুমকি তাতে কাজ হত না। সে কেবলই সেখানে পড়ে রইত, তেমন নাড়াচাড়া না করে। এই সংকট যদি কোনো ধরনের অসুস্থতার কারণে হয়ে থাকত, তবে তারা অসুস্থদের কোয়ার্টারে যেতেও অস্বীকৃতি জানাত বা অস্বীকৃতি জানাত নিজেদের সাহায্যার্থে কোনো কিছু করতে। সে নিতান্তই আশা ছেড়ে দিয়েছে। আর সে জন্যে সে কেবলই তার মল-মূত্রের উপর শুয়ে থাকত, আর কোনো কিছুই তাকে আর বিরক্ত করতে পারতো না।

আমি নিজেই এক সময় ভবিষ্যতের উপর আশা/প্রত্যাশা হারিয়ে ফেলা এবং এই বিপজ্জনক আশা ছেড়ে দেওয়ার মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের এক নাটকীয় দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলাম। আমার সিনিয়র ওয়ার্ডেন মিঃ এফ., যিনি ছিলেন একজন মোটামুটি সু-পরিচিত সুরকার এবং রচনা লেখক, তিনি একদিন আমাকে গোপনে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই, ডাক্তার সাহেব। আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। এক কণ্ঠস্বর এসে আমাকে বলেছিল যে আমি তার কাছে কোনো কিছু চাইতে পারি। কোনো কিছু জানতে চাইলে আমি যেন তাকে প্রশ্ন করি, সে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর দেবে। তোমার কি মনে হয় আমি তার কাছে কি চেয়েছিলাম? আমি জানেতে চেয়েছিলাম কবে আমার জন্য যুদ্ধের সমাপ্তি হবে। তুমি জানো আমি ‘আমার জন্য’ বলতে কি বোঝাতে চেয়েছি, ডাক্তার সাহেব! আমি জানতে চেয়েছিলাম কবে আমরা শিবির মুক্ত হবো এবং আমাদের কষ্টের শেষ হবে।

কবে আপনি এ স্বপ্ন দেখেছেন? আমি প্রশ্ন করলাম।

“ফেব্রুয়ারিতে, ১৯৪৫”, তিনি উত্তর দিলেন। যখন তিনি আমাকে তার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন তখন ইতিমধ্যে মার্চ মাস ছিল।

আপনার স্বপ্নের কণ্ঠস্বর কি উত্তর দিয়েছে?

চুপিসারে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “৩০শে মার্চ”।

মিঃ এফ. যখন আমাকে তার স্বপ্নের ব্যাপারে বলেছিলেন, তখনও তিনি ছিলেন প্রত্যাশায় পূর্ণ এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে তার স্বপ্নের কথা সত্যি হবে। কিন্তু স্বপ্নের সেই দিনটি কাছাকাছি আসলে আমাদের কানে আসা যুদ্ধের খবর থেকে বুঝতে পারি যে, স্বপ্নের সেই দিনেই আমরা মুক্ত হবো। ২৯শে মার্চ মিঃ এফ. হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং উচ্চ তাপমাত্রার জর উঠে। ৩০শে মার্চ, তার ভবিষ্যদ্বাণীর দিন তাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে তার জন্য যুদ্ধ ও কষ্টভোগ শেষ হয়ে যাবে, তিনি বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। ৩১মে মার্চ তিনি মারা যান। বাহ্যিক সকল হাবভাব থেকে বোঝা গেলো যে তিনি টাইফাস রোগে মারা গিয়েছিলেন।

*******

যারা একজন মানুষের মানসিক অবস্থার সাথে তার দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার কতোটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তা জানে, তারা বুঝতে পারবে আকস্মিকভাবে আশা ও সাহস হারিয়ে ফেলাটা স্বাস্থ্যের উপর কতটা মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। আমার বন্ধু মিঃ এফ’র মৃত্যুর চূড়ান্ত কারণ ছিল যে তার প্রত্যাশিত মুক্তি আসেনি আর যে কারণে সে মারাত্মকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিল। তা আকস্মিকভাবে টাইফাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে তার দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দিয়েছিল। ভবিষ্যতের উপর তার বিশ্বাস এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও তার দেহ হয়ে পড়ে অসুস্থতার শিকার—আর এভাবেই তার স্বপ্নে কণ্ঠস্বর সত্যি হয় অবশেষে।

এই একটি ঘটনার উপর ফলাফল আমাদের শিবিরের প্রধান চিকিৎসক কর্তৃক পর্যবেক্ষণ করা ও তার অর্জিত ফলাফল আমার মনোযোগ আরক্ষণ করেছিল। ১৯৪৪ সালের বড়দিন আর ১৯৪৫ সালে নববর্ষের মধ্যে শিবিরের পূর্ববর্তী সব অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে মৃত্যুর হার বেড়ে গিয়েছিল। তার মতে, মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে কাজের কঠিন পরিস্থিতি দায়ী ছিল না। অথবা দায়ী ছিলনা আমাদের খাদ্য সরবরাহের গুনগত বা পরিমাণগত অবনতিও অথবা কোনো আবহাওয়া পরিবর্তন বা নতুন কোনো মহামারি। অধিকাংশ কয়েদি যারা বড়দিনের মধ্যে পুনরায় বাড়িতে থাকতে পারবে এই অতি সরল প্রত্যাশায় জীবন-যাপন করেছিল। আর এই সরল প্রত্যাশাই তাদের মৃত্যুর কারণ ছিল। সময় ঘনিয়ে আসলে এবং উৎসাহমূলক কোনো খবর না পেয়ে বন্দীরা তাদের উৎসাহ হারিয়েছিল আর হতাশা তাদের পরাস্ত করেছিল। আর তাতে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতায় এক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। যার কারণে তাদের একটি বড় সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল।

আমরা যেমনটি আগেই বলেছি, ক্যাম্পে একজন মানুষের আভ্যন্তরীণ শক্তির পদস্থাপনের যেকোনো প্রচেষ্টাই ছিল প্রথমে তাকে ভবিষ্যতের কোনো লক্ষ্য প্রদর্শনে সফল হওয়া। ফ্রেড্রিক নিৎসের, “ যার কেন বেঁচে থাকতে হবে তার কারণ রয়েছে সে প্রায় যে কোন উপায়ই সহ্য করতে সক্ষম ” কথাটি কয়েদিদের সম্পর্কে সকল সাইকোথেরাপিউটিক বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা বা সাইকোহাইজিনিক বা মানসিক স্বাস্থ্যবিধির পথনির্দেশক মূলমন্ত্র হতে পারে। যখনই তার সুযোগ হতো কাউকে না কাউকে কয়েদিদের তাদের জীবনের জন্য একটি ‘কেনো’র মাধ্যমে কোনো লক্ষ্য প্রদান করতে হতো, যাতে তারা তাদের অস্তিত্বের ভয়াবহ ‘কিভাবে’ কে সহ্য করার শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। আফসোস তার জন্য, যে তার জীবনে কোনও অর্থ দেখতে পায়নি। লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন, অতএব বেঁচে থাকার মানে হয় না। সে সহসাই কালের গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছিল। যে সাধারণ উত্তরের মাধ্যমে একজন মানুষ সকল প্রেরণামূলক বিতর্ককে প্রত্যাখ্যান করতো তা ছিল, “আমার জীবন থেকে প্রত্যাশা করার মতো আর কিছুই নেই“। একজন মানুষ তাতে কি উত্তর দিতে পারে?

প্রকৃতপক্ষে আমাদের যা দরকার ছিল তা হলো জীবন সম্পর্কে আমাদের মনোভাবের এক আমূল বা মৌলিক পরিবর্তন। সর্বোপরি, আমাদের নিজেদের শিখতে হয়েছিল, এবং হতাশ লোকদের আমাদের শেখাতে হয়েছিল যে, প্রকৃত অর্থে আমরা জীবন থেকে কি প্রত্যাশা করেছি তা কোনো বিষয় নয়, বরং জীবন আমাদের কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করেছিল তাই আসল বিষয়। জীবনের অর্থ সম্পর্কে প্রশ্ন করা আমাদের থামিয়ে দিতে হয়েছিল, বরং প্রতিদিন আর প্রতি ঘণ্টায় নিজেদেরকে আমাদের জীবন দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ মানুষ হিসেবে ভাবতে হয়েছিল। আমাদের উত্তর আলাপচারিতায় আর ধ্যানের মধ্যে নিহিত ছিল না, বরং তা নিহিত ছিল আমাদের সঠিক কর্ম আর সঠিক আচরণে। অবশেষে, জীবন মানে জীবনের সমস্যা সমাধানের সঠিক উত্তর খুঁজে বের করার দায়বদ্ধতা গ্রহণ করা এবং প্রতিটি মানুষের জন্য জীবন ক্রমাগতভাবে যে কাজ স্থাপন করে তা পরিপূর্ণ করা। তাই এইসব কাজ, আর জীবনের অর্থ একেকজন মানুষের কাছে একেকরকম, এবং ভিন্ন মুহূর্তে ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তাই সাধারণভাবে জীবনের অর্থ বা মানে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব। জীবনের অর্থ বা মানে সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর কখনোও সুদূরপ্রসারী উক্তি দ্বারা দেওয়া সম্ভব নয়। ‘জীবন’ মানে অনিশ্চিত কোনো কিছুকে বোঝায় না, কিন্তু খুবই বাস্তব আর মূর্ত কোনো কিছুকে বোঝায়, ঠিক যেমন জীবনের কাজও খুবই বাস্তব আর মূর্ত। এসব কাজ মানুষের নিয়তিকে গঠন করে, যা প্রতিটি মানুষের জন্য ভিন্ন আর অনুপম। কোনো ব্যক্তি আর কোনো নিয়তি বা গন্তব্যকে অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে বা অন্য কোনো গন্তব্যের সাথে তুলনা করা যাবে না। কোনো পরিস্থিতিরই পুনরাবৃত্তি হয় না, তাই প্রতিটি পরিস্থিতিই ভিন্ন ভ্ন্নি প্রতিক্রিয়ার দাবি রাখে। মাঝে মাঝে একজন মানুষ নিজেকে যে পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করে তাতে হয়তো কর্মের দ্বারা তার নিজের নিয়তি নির্ধারণের দরকার হয়। মাঝে মাঝে গভীর চিন্তা ও এভাবে তার গুণাবলিকে উপলব্ধির জন্য কোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার তার জন্য অধিকতর সুবিধাজনক। মাঝে মাঝে একজন মানুষকে সাদাসিধেভাবে তার নিয়তিকে গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় তার যন্ত্রণা বহন করার। প্রতিটি পরিস্থিতিই তার অনন্যতার দরুন স্বতন্ত্র, এবং আসন্ন পরিস্থিতির দ্বারা সৃষ্টি সমস্যার জন্য সব সময় কেবল একটি সঠিক উত্তরই থাকে।

Romzanul Islam

Thinking out of the convention and moving forward with knowledge and reasons are always my styles. Researching, watching the best films, and reading and collecting the best books to enrich me is my deadly passion. Stoicism, liberalism, feminism and aversion to material success are my ideals.