man's search for meaning Bangla translation

Man’s Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023

  • Post author:
  • Post last modified:24 January 2024

Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm

আদিম জীবন ধারণ আর কেবল নিজের জীবন বাঁচিয়ে রাখার প্রতি কেন্দ্রীভূত প্রচেষ্টা অধিকাংশ বন্দীকে যা কিছু সেই উদ্দেশ্য সাধন করে না তাকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করার দিকে ধাবিত করেছিলো। আর তা বন্দীদের অনুভূতি-হীনতার কারণও হয়ে উঠেছিল। অশউইৎস থেকে জার্মানির ডাক্সাও বন্দী শিবিরে হস্তান্তর করার পর তা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি। প্রায় ২০০০ বন্দীকে বহন করে নিয়ে যাওয়া ট্রেনটি অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা হয়ে চলে গেলো। প্রায় মাঝরাতে ভিয়েনার কয়েকটি রেল স্টেশন অতিক্রম করি। পথটি আমি যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলাম সে সড়ক, যে বাড়িতে বন্দী করে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আমার জীবনের অধিকাংশ বছর পার করেছি তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমাদের পঞ্চাশ-জন বন্দীকে বহন করা কামরায় উঁকি দিয়ে দেখার জন্য দুটি খিল আঁটা ছোট ছিদ্র ছিল। 

শুধু একদল মানুষের জন্য মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসার পর্যাপ্ত জায়গা ছিল। বাকিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিদ্রগুলির পাশে ভিড় করছিল। পায়ের আঙ্গুলে দাঁড়িয়ে ও অন্যদের মাথার উপর দিয়ে ছিটকানির ভেতর দিয়ে চোখ রাখলে আমার স্থানীয় শহরের আতঙ্কজনক দৃশ্য আমার চোখে ধরা দেয়। সবাই যেন জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে বেশী অনুভব করেছিলাম তখন, কারণ আমাদের ধারনা ছিল ট্রেনটি অস্ট্রিয়ার মথাসেন বন্দী শিবির অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল। মথাসেন বন্দী শিবিরের দিকে যাওয়া মানে জীবনের দু’য়েক সপ্তাহ বাকি থাকা। আমার পরিষ্কার অনুভূতির মাধ্যমে এক মৃত মানুষের দৃষ্টি দিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার ছেলেবেলার সড়ক সমূহ, বাড়িঘর বেষ্টিত উন্মুক্ত স্থান ও বাড়িঘর। মনে হচ্ছিল যেন এক অন্য জগত থেকে ফিরে আসা এক মৃত মানুষ ভৌতিক কোনো শহরের দিকে তাকাচ্ছে।

কয়েক ঘণ্টা বিলম্বের পর ট্রেনটি ষ্টেশন ত্যাগ করে। কয়েকজন বালক যারা শিবির জীবনে কয়েক বছর পেছনে ফেলে এসেছে এবং যাদের কাছে এরকম কোনো যাত্রা ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য তারা মনোযোগের সাথে সেই ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে উঠে, “ঐ-তো মহা-সড়কটি-আমার মহাসড়ক”!। আমি তাদের অনুনয়-বিনয় করে অনুরোধ করে বলেছিলাম তারা যেন আমাকে কেবল এক মুহূর্তের জন্য ছিদ্রগুলি সামনে দাঁড়াতে দেয়। জানালার ভেতর দিয়ে আমার শহরকে এক দৃষ্টি দেখা কতটা দরকার তা আমি তখন তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। আমার অনুরোধকে তারা রুক্ষতা আর হতাশার সাথে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “এতগুলি বছর আপনি এখানে কাটিয়েছেন? বেশ, তাহলো তো আপনি ইতিমধ্যেই অনেক দেখে ফেলেছেন, আর দেখতে হবে না!”

সাধারণত শিবিরে একটি  “cultural hibernation” বা  “সাংস্কৃতিক শীতলতা বা নিষ্ক্রিয়তা”র একটি বিষয় ছিল। রাজনীতি এবং ধমের্র মতো দুটি বিষয় এই সাংস্কৃতিক শীতলতার বাইরে ছিল।  শিবিরের সবখানেই ,অনেকটা একটানাভাবে, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতো। আর এই আলোচনা ছিল মূলত গুজব ভিত্তিক, যা তড়িঘড়ি করে সংগ্রহ করে সাগ্রহে বিলি করে দেওয়া হতো। সেনা পরিস্থিতি নিয়ে গুজব সমূহ প্রায়শই ছিল পরস্পরবিরোধী। এসব গুজব একে একে সবাইকে দ্রুত প্রভাবিত করে কয়েদিদের মনে স্নায়ু যুদ্ধ সৃষ্টিতে অবদান রাখতে সফল হয়েছিল। অনেক সময়, চলমান যুদ্ধের অবসান হয়ে যাওয়ার অনেক আশাবাদী গুজব বহু প্রত্যাশাকে নিরাশ করে দিয়েছিল। কিছু মানুষ সমস্ত আশা হারিয়ে ফেলে। তবে একরোখা আশাবাদীরাই ছিল সবচেয়ে বিরক্তিকর সঙ্গী। কয়েদিদের কাছে ধর্মীয় আগ্রহ খুব দ্রুত প্রচার আর প্রসার লাভ করতো।

তাদের ধর্মীয় আগ্রহ ছিল অকল্পনীয়ভাবে অকৃত্রিম। ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি তাদের গভীরতা আর দৃঢ়তা প্রায় সময় একজন নতুন আগত কয়েদিকে হতবাক এবং আন্দোলিত করতো। কোনো এক ছাউনির কোনায় বা গবাদিপশু বহনের বদ্ধ ট্রাকের অন্ধকারে তাৎক্ষণিকভাবে আয়োজন করা প্রার্থনা বা প্রার্থনা-অনুষ্ঠান ছিল ধর্মীয় আগ্রহের সাথে সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে মনোযোগ আকর্ষণকারী বিষয়। তাতে  অংশগ্রহণের জন্য দূরদূরান্তের কর্ম স্থল থেকে, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত আর জরাজীর্ণ বস্ত্রে হাড় কাঁপানো শীতে আমাদের ফিরে যেতে হতো।

১৯৪৫ সালের শীত ও বসন্তকালে বয়ে যাওয়া টাইফাস রোগের মহামারি শিবিরের প্রায় সব কয়েদিদের আক্রান্ত করে বসে। দুর্বলদের মাঝে মৃতের হার ছিল বেশি। তাদরে যতোটা সম্ভব কঠোর পরিশ্রমে ব্যস্ত রাখতে হয়েছিল। অসুস্থদের কোয়ার্টারগুলি ছিল সবচেয়ে বেশি অনুপযুক্ত স্থান, যেখানে বলতে গেলে ছিল না কোনো ঔষধ-পত্র বা রোগীদের দেখাশুনা করার মতো কোনো লোকজন। টাইফাসের কোনো কোনো লক্ষণ ছিল একেবারে আলাদা। সামান্যটুকু খাবারের প্রতি অদম্য অনীহা ছিল জীবনের জন্য একটি বাড়তি বিপদ। তার সাথে ছিল অসুস্থাবস্থায় প্রলাপ বিকারের ভয়াবহ আক্রমণ। আমার এক বন্ধু বিপদজনকভাবে প্রলাপ বিকারে ভুগেছিল। সে ভেবেই নিয়েছিল যে সে মরে যাবে আর তার জন্য সে শেষবারের মতো প্রার্থনা করতে চেয়েছিল। প্রলাপের ঘোরে সে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। এ ধরনের প্রলাপ বিকারের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য অনেকের মতো আমি নিজেকে জাগিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলাম অধিকাংশ রাত। অবশেষে, অশউৎসের জীবানুমুক্তকরণ বুথে আমার যে পাণ্ডুলিপিটি হারিয়েছিলাম উচ্ছিষ্ট কাগজের টুকরায় বিশেষ মন্তব্যগুটি টুকে রেখে তা পুনরায় লিখার কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম।

কোনো এক বিশেষ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শিবিরে একটি বৈজ্ঞানিক বিতর্কের উন্নতি ঘটে। এক সময় শিবিরে আমি এমন কিছু জিনিস দেখি যা আমি আমার স্বাভাবিক জীবনে কখনও দেখিনি, যদিও তা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কিছুটা আমার নিজের পেশাগত আগ্রহের কাছাকাছি ছিল। অনুষ্ঠানটি ছিল মৃতদের সঙ্গে আধ্যাত্মিকভাবে ভাবের আদান-প্রদানের জন্য বৈঠক। শিবিরের একজন কয়েদি প্রধান চিকিৎসক আমাকে অনুষ্ঠানটিতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি জানতেন যে আমি একজন মনোরোগবিদ্যার বিশেষজ্ঞ। অসুস্থদের কোয়ার্টারে তার ছোট গোপন কক্ষে আমাদের সাক্ষাত হয়। ছোট গোলাকারে আগন্তুকরা জমায়েত হলো। যাদের মধ্যে, বেশ অবৈধভাবে, উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য-সুরক্ষা দলের ওয়ারান্ট অফিসার। একব্যক্তি একধরনের প্রার্থনার মাধ্যমে আত্মার আহ্বান করা শুরু করে দিলেন। কোনো কিছু লিখার মনস্থির না করে শিবিরের কেরানী একটুকরো সাদা কাগজের শিটের সামনে বসে পড়লো। পরবর্তী দশ মিনিট পর মন্ত্র উচ্চারণ করার মাধ্যমে দিয়ে ভূত বা আত্মার প্রকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হওয়ায় মৃতদের আত্মার সাথে ভাবের আদান-প্রদান অনুষ্ঠান ভণ্ডুল হয়ে যায়। তারপর কেরানী কাগজের উপর পেন্সিল দিয়ে সরলরেখা মতো কি একটা আঁকলেন যা ক্রমে ক্রমে দেখতে অনেকটা ল্যাটিন “VAE V” এর মতো হয়ে উঠলো। ধারনা করা হয়েছিল যে কেরানীটি কখনও ল্যাটিন ভাষা শেখেননি ও এর আগে কখনও তিনি “VAE V” বা “vae victis” কথাগুলি শোনেননি। যার অর্থ “ধিক পরাজিতদের”। আমার ধারনা সে কোথাও না কোথাও সে কথাগুলি শুনেছিলেন যা সে স্মরণ করতে পারছিলেন না। আমাদের মুক্তির কয়েকমাস পূর্বে এবং যুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে তার spirit of subconscious mind বা তার অবচেতন মনের আত্মায় আবির্ভূত হয়।

*******

বন্দী শিবিরে জীবন-যাপনের সকল চাপিয়ে দেওয়া শারীরিক ও মানসিক আদিমত্ব (mental primitiveness) সত্ত্বেও আধ্যাত্মিক জীবনকে আরও উন্নত করা সম্ভব ছিল। সমৃদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত স্পর্শকাতর ব্যক্তিরাই সম্ভবত বেশি কষ্ট পেয়েছিলো। তারা প্রায়শই এক নমনীয় জীবন-বিধানের পক্ষে কথা বলতো। তথাপি তাদের আভ্যন্তরীণ সত্ত্বার (inner selves) ক্ষতিসাধন ছিল কম। তারা তাদের চারপাশের ভয়ানক পরিবেশ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে এক মানসিকভাবে সমৃদ্ধশীল এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির জীবনে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছিল। কেবল এভাবেই কম কষ্টসহিষ্ণু কয়েদিরা কিভাবে শক্তিশালী প্রকৃতির লোকদের চেয়ে দিব্যি ভালোভাবেই শিবিরে বেঁচে থেকেছিল সেই লক্ষণীয়  বৈপরীত্য paradox কে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করতে আমাকে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ফিরে যেতে হলো বাধ্য হয়ে। সকালে কুচকাওয়াজ করতে করতে আমাদের যে কাজের স্থানে যেতে হয়েছিল সেখানে কি ঘটেছিল তা বলছি।

উচ্চ চিৎকারে আমাদের আদেশ দেওয়া হচ্ছিল: ডিটাচমেন্ট, সম্মুখে মার্চ করো! লেফট -২-৩-৪! লেফট -২-৩-৪! লেফট -২-৩-৪! লেফট -২-৩-৪! প্রথম-জন, লেফট এন্ড লেফট, লেফট এন্ড লেফট! ক্যাপ খুলে ফেলো! এই কথাগুলি এখনও আমার কানে বাজে। “ক্যাপ খুলে ফেলো” বলার সাথে সাথে আমরা শিবিরের ফটক পার হয়ে যেতাম। তখন অনুসন্ধান টাওয়ার থেকে আলো এসে আমাদের উপর পড়তো। ডানপিটে ভঙ্গিতে কেউ মার্চ করতে ব্যর্থ হলে তার জন্যে ছিল  লাথি। অনুমতি না পাওয়ার আগে ঠাণ্ডার কারণে কেউ যদি তার টুপিটি টেনে কান ঢাকার চেষ্টা করতো, তখনই তার চেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিসটি ঘটতো।

মার্চ করার সময় শিবির থেকে আসা একটি সড়কের পাশ দিয়ে বড় বড় পাথরের উপর ও বৃহদাকার ডোবাগুলোর মধ্য দিয়ে যেতেই অন্ধকারে আমরা থমকে গেলাম। তাতে আমাদের সঙ্গে থাকা প্রহরীরা আমাদের উপর চিৎকার করছিল আর তাদের রাইফেলের প্রান্ত দিয়ে আমাদের তাড়া করছিল। পায়ে ক্ষত থাকাতে কেউ কেউ তার পাশের জনের বাহুতে ভর করে হাঁটছিল। কেউ কোনো কথা বলার চেষ্টা করেনি। কনকনে হাওয়া সবাইকে কথা বলা থেকে বিরত রাখে। জামার ঊর্ধ্বমুখী কলারে মুখ লুকিয়ে আমার পাশ দিয়ে মার্চ করতে থাকা এক লোক আমাকে কানে কানে বলেছিল: “আমাদের স্ত্রীরা যদি এই মুহূর্তে আমাদের দেখতে পেতো! আশা করি তারা তাদের শিবিরে ভালই আছে আর এখানে আমাদের সাথে কি ঘটেছে তা জানে না”।

********

মুহূর্তটি আমার মনে আমার স্ত্রীর ভাবনা বয়ে নিয়ে আসল। আর কোনো কথা না বলে মাইলের পর মাইল যখন আমরা বরফে পা পিছলে হোঁচট খেতে খেতে বারবার একে অন্যের উপর ভর করে, একে অন্যকে টেনে-হিঁচড়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমরা উভয়েই জানতাম যে আমরা দু’জনেই আমাদের স্ত্রীদের কথা ভাবছিলাম। মাঝে মাঝে আমি আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলাম। দেখলাম নক্ষত্ররা ম্লান হয়ে যাচ্ছিল আর ভোরের গোলাপি আলো এক সারি কালো মেঘের পেছনে ছড়িয়ে পড়ছিল। আমার মন তখনও আমার স্ত্রীর চেহারায় আটকে রয়েছে, এক অদ্ভুত সূক্ষ্মতার সাথে আমি তার প্রতিচ্ছবি কল্পনা করছিলাম। আমি তাকে সাড়া দিতে শুনলাম, দেখলাম তার হাসি, তার অকপট আর অনুপ্রেরণামূলক অবয়ব। সত্য হোক, আর মিথ্যে হোক তার চেহারার সৌন্দর্য তখন উদীয়মান সূর্যের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল ছিল।

একটি চিন্তা এসে আমাকে অবশ করে বসে: জীবনের প্রথম আমি বহু কবিদের গানের সত্যতা বুঝতে পারি করি। বুঝতে পারি ভালবাসা সম্পর্কে বহু জ্ঞানীদের জ্ঞানে চূড়ান্ত সত্যের অস্তিত্ব। আসল কথা হলো: ভালবাসাই হচ্ছে একজন মানুষের প্রত্যাশিত চূড়ান্ত এবং সর্বোচ্চ লক্ষ্য। তারপর আমি মানব কাব্য আর মানব চিন্তার ও মানব বিশ্বাসের আরোপ করা সবচেয়ে গোপন রহস্যের অর্থ অনুধাবন করি: ভালবাসার মাধ্যমে ও ভালোবাসার মাঝেই মানুষের মুক্তি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই অবশিষ্ট না থাকলেও প্রিয়তমাকে কল্পনা করার মাঝে ভালোবাসার স্বর্গসুখ অনুভব করার ক্ষমতা রয়েছে। হোক তা  সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। একদম নিঃসঙ্গতা অবস্থায় মানুষ যখন ইতিবাচক কাজে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না, যখন তার একমাত্র সফলতা সঠিক ও সম্মানজনক উপায়ে কষ্টভোগের মধ্যে নিহিত থাকে, এমন পরিস্থিতিতে তার বয়ে চলা প্রেয়সীর প্রতিচ্ছবির প্রতি প্রেমময় ধ্যানের মধ্য দিয়ে সে জীবনের পরিপূর্ণতা লাভ করে। জীবনের প্রথম আমি ‘অপার মহিমার অবিরত ধ্যানে ফেরেশতারা হারিয়ে গেছে’ কথাটির মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারি।

তখন হঠাৎ এক লোক আমার সামনে হোঁচট খেয়ে পড়লো আর তাকে অনুসরণকারীরা পড়লো তার উপরে। প্রহরীটি তড়িঘড়ি করে এসে তাদের সবার উপরে চাবুক ব্যবহার শুরু করে দেয়। এতে করে কয়েক মিনিটের জন্য আমার প্রিয়তমাকে নিয়ে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। তথাপি শীঘ্রই আমার আত্মা সে বন্দিত্বের জীবন থেকে অন্য এক জগতে ফিরে যায়, আর আমি আমার ভালবাসার মানুষটির সাথে বাক্য বিনিময় শুরু করি: আমি তাকে প্রশ্ন করি, সেই উত্তর দেয়; সে প্রশ্ন করলে আমি উত্তর দিলাম।

প্রহরী চিৎকার করে বলে উঠলেন, “থামাও”! ততক্ষণে আমরা আমাদের কাজ করার স্থানে চলে এসেছি। তাড়াহুড়া করে সবাই মোটামুটি ভাল কাজের যন্ত্রের প্রত্যাশায় ছাউনিতে ঢুকে পড়লো। প্রত্যেকেই একটি করে কোদাল বা পিক্যাক্স পেল।

“তাড়াতাড়ি করতে পারিস না, শুকরের বাচ্চারা”? প্রহরী ধমক দিয়ে বললেন। শীঘ্রই আমরা পূর্ববর্তী দিনের স্থান থেকে পরিখার ভেতরে পুনরায় কাজ শুরু করলাম। কোদালের আঘাতে হিমায়িত ভূমিতে ফাটল আর স্ফুলিঙ্গ তৈরি হচ্ছিল। লোকজন ছিল নীরব, তাদের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে উঠে ।

আমার মন তখনও আমার স্ত্রীর প্রতিচ্ছবিতে আটকানো। আমার প্রিয়তমা তখনও বেচে আছে না মারা গেছে সে চিন্তাটি আমার মানসপটে একটি ভাবনা দুল খেয়ে গেলো। তারপরও আমি শুধু একটি জিনিসই জানতাম, যা ইতিমধ্যে আমি ভালভাবেই রপ্ত করে পেলেছিলাম। আমি জানতাম যে, ভালবাসার মানুষের শারীরিক সত্ত্বার চেয়েও অনেক দুরে ভালবাসা বিরাজ করে। ভালোবাসা তার ভালোবাসার মানুষের আধ্যাত্মিক অস্তিত্বে, আভ্যন্তরীণ সত্ত্বায় (inner self) গভীরতম অর্থ খুঁজে পায়। তার ভালোবাসার মানুষটি প্রকৃত অর্থে উপস্থিত কিনা, জীবিত কিনা সে প্রশ্ন কোনো না কোনোভাবে ভালবাসার গুরুত্ব থামিয়ে দেয়।

আমার স্ত্রী জীবিত ছিল কিনা তা আমি জানতাম না, বা তা জানার কোনো উপায়ও ছিল না, কারণ আমার বন্দীদশা অবস্থায় ভেতর-বাইরের খবরা-খবর আদান-প্রদানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তবুও সে মুহূর্তে তা কোনো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় নি। তা জানার দরকার ছিল না আমার; আমি কেবল জানতাম যে কোনো কিছুই আমার ভালোবাসার শক্তিকে, আমার ভাবনাকে, ও আমার প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবিকে স্পর্শ করতে পারবে না। তখন যদি আমি আমার স্ত্রীর মৃত্যু সম্পর্কে জানতামও, তাহলে আমার মনে হয় আমি সে খবরে কোনো ধরনের বিচলিত না হয়ে তার প্রতিচ্ছবিতে নিজেকে আবিষ্ট করে রাখতাম। আর তার সাথে আমার মানসিক ভাবের আদান-প্রদান হতো ঠিক বাস্তবের মতো জীবন্ত আর তৃপ্তিকর। “সিল মোহরের ন্যায় তুমি আমায় তোমার হৃদয়ে স্থাপন করো, ভালোবাসা মৃত্যুর মতোই শক্তিশালী”।

*********

আভ্যন্তরীণ জীবনের এই তীব্রতা বন্দীদের আত্বঃসারশুন্যতা, নিঃসঙ্গতা এবং তার অস্তিত্বের আত্মিক দীনতা থেকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে আশ্রয় খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। কল্পনার স্বাধীনতায় সে তার অতীতের তুচ্ছ আর মামুলি মুহূর্তগুলি নিয়ে খেলা করে। তার গৃহকাতর স্মৃতি সেসব তুচ্ছ ঘটনা সমূহকে মহিমান্বিত করে তুলে ও তা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। তাদের জগত এবং তাদের অস্তিত্বকে অনেক দূরে বলে মনে হয়েছিল। আত্মা তবুও ব্যাকুলভাবে তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল: মনে মনে আমি বাসে করে বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছি, আমার সামনের এপার্টমেন্টের দরজা খুলেছি, কারো টেলিফোনের উত্তর দিয়েছি, বৈদ্যুতিক আলোর চুইস চালু করেছি। আমাদের ভাবনা সমূহ এতই পুঙ্খানুপুঙ্খ কেন্দ্রিক ছিল যে এসব স্মৃতি সহজেই কাউকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিত।

একজন কয়েদির আভ্যন্তরীণ জীবন (inner life) আরও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠার প্রবণতা দেখা দিলে সে অতীতের তুলনায় বেশি শিল্প আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতাও লাভ করতে থাকে। শিল্প আর প্রকৃতির সৌন্দর্যর প্রভাবে সে অনেক সময় তার ভয়ানক চারপাশের কথাও ভুলে যেতো। অশউইৎয শিবির থেকে বাভারিয়ান শিবিরে যাওয়ার সময় কয়েদি বহন করা গাড়ির লোহা ঢাকা জানালার ভেতর দিয়ে অস্ট্রিয়ার সালযবুর্গ শহরের সূর্যাস্তের সময় আলোকিত পর্বতচূড়া দেখে আমাদের চেহারার যা অবস্থা হয়েছিল তা কেউ দেখলে বলতে পারবে না যে জীবন আর স্বাধীনতার সকল আশা ছেড়ে দেওয়া মানুষগুলোর চেহারা। আশা ছেড়ে দেওয়া সত্ত্বেও বা আশা ছেড়ে দেওয়ার কারণেই, আমরা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, যার কথা আমাদের দীর্ঘদিন মনে থাকে।

শিবিরেও কোনো ব্যক্তি বাভারিয়ান বনের সু-উচ্চ বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে সমুজ্জ্বল ডুবন্ত সূর্যের মনোরম দৃশ্যের প্রতি তার পাশে কর্ম ব্যস্ত সহকর্মীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। জার্মান শিল্পী ডিউরের বিখ্যাত জলরঙের ছবিতে যেমন দেখা যায়। বাভারিয়ানের সেই বনের ভেতরে আমরা বিশালাকার গোপন অস্ত্র কারখানাটি নির্মাণ করেছিলাম। প্রচুর ক্লান্ত হয়ে এক সন্ধ্যায় আমরা যখন ছাউনির মেঝেতে স্যুপের বাটি হাতে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ এক কয়েদি দৌড়ে এসে আমাদের সমাবেশ মাঠে অপরূপ সূর্যাস্ত দেখার আহ্বান করে। বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম পশ্চিম দিকে অশুভ মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আর মনে হলো সমস্ত আকাশ চির-পরিবর্তনশীল আকৃতি ধারণ করেছে এবং ইস্পাত নীল থেকে রক্ত-লাল রঙে সজীব হয়ে আছে। মাটির তৈরি নির্জন ধূসর রঙের ছাউনিগুলি এক তীক্ষ্ণ বৈপরীত্য স্থাপন করছিল তখন। কাদামাখা ভূপৃষ্ঠের ডোবাগুলিতে প্রদীপ্ত আকাশ প্রতিফলিত হয়েছিল। তারপর, কয়েক মিনিটের মুগ্ধ করা নীরবতার পর এক কয়েদি আরেক কয়েদিকে বলে, “জগত কতোটা সুন্দর হতে পারে”!

অন্য এক সময় আমরা পরিখার ভেতরে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের চারপাশে তখনও ধূসর ভোর; উপরের আকাশও ছিল ধূসর; ভোরের ম্লান আলোয় তুষারও ছিল ধূসর রঙে ঢাকা। যে পুরনো ছেঁড়া পোশাকে আমার সহ-বন্দীরা আবৃত ছিল তাও ছিল ধূসর রঙ্গের, আর ধূসর ছিল তাদের মুখমণ্ডলও। নিবৃতে আমি পুনরায় আমার স্ত্রীর সাথে আলোচনা করছিলাম। অথবা হতে পারে তখন আমি আমার যন্ত্রনাভোগ ও ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়ার পেছনে কারণ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আমি আমার আত্মাকে আবৃত করে রাখা অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে আসন্ন মৃত্যুকে নিয়ে হতাশার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহী প্রতিবাদ অনুভব করি। আমি অনুভব করলাম এই বিদ্রোহী প্রতিবাদ যেন সেই নিরাশ, অর্থহীন জগতের সবখানে ছড়িয়ে পড়ছে। আর কোথাও কোথাও থেকে আমি বিজয়ী “Yes” শুনতে পায়। তা যেন বেঁচে থাকার পেছনে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে আমার প্রশ্নের উত্তর। ঠিক সেই মুহূর্তে দূরের এক খামারবাড়িতে প্রদীপ জ্বলে উঠে। তা দেখে মনে হয়েছিল যেন তা একে রাখা এক চিত্রকমের্র মতো বাভারিয়ায় অগ্রসরমান ভোরের দুর্বিষহ ধূসরতার মাঝে দিগন্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। “Et lux in tenebris lucet” আর অন্ধকারে আলো জ্বলল। বরফে ঢাকা মাটিতে কোদাল কোপাতে কোপাতে আমি কয়েক ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেছিলাম। আমাকে অপমান করে এক প্রহরী আমার পাশ দিয়ে চলে গেলো। আর আমি পুনরায় আমার প্রিয়তমার সাথে ভাব-বিনিময় শুরু করে দেই। আমি আরও বেশি তার উপস্থিতি অনুভব করি, মনে হচ্ছিল সে যেন আমার সাথেই রয়েছে। আমি অনুভব করলাম আমি যেন তাকে স্পর্শ করতে পারছিলাম। পারছিলাম আমার বাহু প্রসারিত করে তাকে জড়িয়ে ধরতে। সে অনুভূতি ছিল খুবই শক্তিশালী: আমার প্রিয়তমা সেখানে উপস্থিত ছিল। তারপর ঠিক সেই মুহূর্তে একটি পাখি নীরবে উড়ে এসে আমার সামনে, পরিখা থেকে কুড়ে বের করে আনা কাদার স্তূপে বসলো, আর স্থিরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

আগেও আমি শিল্প সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করেছিলাম। বন্দী শিবিরে কি আসলে শিল্প বলতে কিছু ছিল? তা বরং কে কোন জিনিসকে শিল্প হিসেবে ব্যাখ্যা দেবে তার উপর নির্ভর করে। যুগ যুগ ধরে গান গেয়ে বা নেচে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ক্যাবারেই (cabaret) ব্যবহার করা হয়ে আসছে। ক্ষনস্থায়ীভাবে একটি ছাউনি পরিষ্কার করে কয়েকটি কাটের বেঞ্চ একত্রিত করে বা পেরেক দিয়ে একসাথে করে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। যে সব ক্যাপু ও শ্রমিকদের দূরবর্তী কোনো জায়গায় মার্চ করার উদ্দেশ্যে শিবির ত্যাগ করতে হয়নি এমন পদাতিক লোকজন সে সন্ধ্যায় মোটামুটিভাবে শিবিরের সেই অনুষ্ঠানে জড়ো হয়েছিল। তারা সবাই শিবির জীবনের যন্ত্রণা ভুলতে সেখানে কিছুটা বিনোদন বা সম্ভবত একটু কেঁদে কষ্ট লাগব করতে এসেছিলো। সঙ্গীত, কবিতা, কৌতুক, শিবির জীবনকে কেন্দ্রকরে রসিকতায় ভরপুর ছিল জমায়েতটি। সবকিছুই আমাদের কষ্ট লাগবে সাহায্য করার কথা ছিল, আর তাই হয়েছিল। মিলন-মেলাটি এতই কার্যকর ছিল যে কয়েকজন সাধারণ কয়েদি ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও বারের ক্যাবারেই (cabaret) নাচ-গান দেখতে চলে গিয়েছিল, যদিও তাতে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত দৈনিক খাবারের অংশটি হারাতে হয়েছিল।

Romzanul Islam

Thinking out of the convention and moving forward with knowledge and reasons are always my styles. Researching, watching the best films, and reading and collecting the best books to enrich me is my deadly passion. Stoicism, liberalism, feminism and aversion to material success are my ideals.