man's search for meaning Bangla translation

Man’s Search for Meaning Bangla-ম্যান্স সার্চ ফর মিনিং জীবন বদলে দেওয়া Inspiring বইয়ের বাংলা অনুবাদ 2023

  • Post author:
  • Post last modified:24 January 2024

Last updated on January 24th, 2024 at 02:19 pm

পুনশ্চ ১৯৮৪

আশাবাদের দুঃখজনক ঘটনা* Tragic Optimism

* অধ্যায়টি বিশ্ব তৃতীয় লগোথেরাপি সম্মেলন, রেজেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিম জার্মানী, জুন ১৯৮৩’তে আমার দেওয়া লেকচারের উপর ভিত্তি করে রচিত।

এডিথ ওয়েসকপফ জুয়েসনের স্মৃতিতে উৎসর্গকৃত, যার অগ্রণী প্রচেষ্টায় ১৯৫৫ সালের দিকে যুক্ত রাষ্ট্রে লগোথেরাপি শুরু এবং যার অবদান এ ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রাখে।

প্রথমেই আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে “a tragic optimism” বা ‘দুঃখজনক আশাবাদ’ এর দ্বারা কি অনুধাবন করা উচিৎ। সংক্ষেপের এর মানে হলো যে কোনো ব্যক্তি tragic triad বা ‘দুঃখজনক ত্রয়ী’ সত্ত্বেও আশাবাদী, এবং আশাবাদী থাকেন। লগোথেরাপি অনুযায়ী tragic triad বা ‘দুঃখজনক ত্রয়ী’তে মানব অস্তিত্ত্বের সে সমস্ত দিকগুলিকে (১) যন্ত্রনা, (২) অপরাধবোধ, এবং (৩) মৃত্যু দ্বারা পরিবেষ্টিত করা যেতে পারে। বস্তুত, এই অধ্যায় ‘সে সব সত্ত্বেও জীবনের প্রতি কিভাবে হ্যাঁ বলা সম্ভব?’ সে প্রশ্নসমুহ উত্থাপন করে। কিভাবে, প্রশ্নটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে গেলে, দুঃখজনক দিক সমূহ (১. যন্ত্র, ২. অপরাধবোধ ও ৩. মৃত্যু ) সত্ত্বে জীবন কিভাবে তার সম্ভাব্য অর্থ ধরে রাখতে পারে? সর্বোপরি, “সবকিছু সত্ত্বেও জীবনের প্রতি হ্যাঁ বলা”, যে বাক্যাংশের ভিত্তিতে জার্মান ভাষায় লিখা আমার এক বইয়ের শিরোনাম প্রকাশ করা হয়েছিল, থেকে অনুমান করে নেওয়া হয় যে, যেকোনো পরিস্থিতিতে জীবন সম্ভাবনীয়রূপে অর্থবহ, এমনকি সবচেয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতিতেও। আর এটি বদলে সৃজনশীলভাবে নেতিবাচক দিকগুলিকে ইতিবাচক বা গঠনমূলক কোনো কিছুতে রূপান্তর করার মানব সামর্থকে অনুমান করে। অন্য অর্থে, যা আসলেই ব্যাপার তা হলো নির্দিষ্ট অবস্থার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা। যাহোক, “সর্বোত্তম” কে ল্যাটিন ভাষায় বলা হয় optimum বা সবচেয়ে অনুকূল – সুতরাং সেজন্যে আমি এক দুঃখজনক আশাবাদ, তা হলো মর্মান্তিক ঘটনার মুখে এক দুঃখজনক আশাবাদ ও মানব সম্ভাবনার লক্ষ্যে যা সর্বোত্তম উপায়ে সবসময়ই (১) যন্ত্রনাকে মানব সফলতা এবং অর্জনে রুপান্তর করার, (২) অপরাধবোধ থেকে নিজেকে ভালোর জন্য পরিবর্তনের সুযোগ আহরণ করার জন্য, আর (৩) জীবনের ক্ষনস্থায়ীত্ব থেকে দায়বদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উদ্দীপনা আহরন করার অনুমোদন দেয়।

সুতরাং মনে রাখা দরকার যে, আশাবাদ কোনো আদেশ বা নির্দেশ করার মতো কিছু নয়। সমস্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধে, সকল আশার বিরুদ্ধে নির্বিচারে কেউ নিজেকে বলপূর্বকভাবে আশাবাদী করতে পারে না। আর যে জিনিসটি আশার ক্ষেত্রে সত্যি, তা একইভাবে সত্যি ত্রয়ীর অন্য দুই উপাদানের ক্ষেত্রেও যেমনটি বিশ্বাস আর ভালোবাসাকে আদেশ বা নির্দেশ করা যায় না।

ইউরোপীয়দের কাছে আমেরিকান সংস্কৃতির একটি এক বৈশিষ্ট্য যে “সুখি হওয়ার” জন্য কাউকে বার বার আদেশ বা নির্দেশ করা হয়। কিন্তু সুখকে অন্বেষণ করা যায় না; তাকে সংঘটিত বা ঘটাতে হয়। “সুখি হওয়ার” জন্য কারো কোনো কারণ থাকা চাই। যখনই তার কারণ আবিষ্কৃত হয়, যাইহোক, সে আপনাআপনিতেই সুখি হয়ে উঠে। আমরা যেমন লক্ষ্য করি, কেউ সুখের অন্বেষণে একজন মানুষ নন বরং, শেষ কিন্তু ছোট নয়, এক প্রদত্ত পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য সহজাত ও সুপ্ত অর্থ’কে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুখি হওয়ার কারণ সন্ধানে সে।

কারণ বা হেতুর এই প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অন্য এক মানবীয় ঘটনা ‘হাসি’র বেলায় একই জিনিস লক্ষ্য করা যায়। আপনি যদি কাউক হাসাতে চান তাহলে তাকে আপনার হাসার কারণ সরবরাহ করতে হবে, যেমন, তাকে আপনি কোনো কৌতুক বলবেন। অন্য কোনোভাবেই তাকে অনুরোধের মাধ্যমে বা নিজেকে হাসার অনুরোধ করে প্রকৃত হাসির উদ্রেগ করা সম্ভব নয়। তা করতে গেলে কোনো ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে “ছিয” (cheese) বলার জন্য অনুরোধ করার সমতুল্য হবে; তাতে কেবল দেখা যাবে চুড়ান্ত ছবিতে কৃত্রিম হাসিতে তাদের হিমায়িত অবয়ব সমূহ।

লগোথেরাথিতে এধরনের আচরণকে বলা হয় hyper-intention বা অত্যধিক অভিপ্রায়। যৌন স্নায়ুবৈকল্য হওয়ার পেছনে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে, হতে পারে তা কামশীতলতা বা যৌন অক্ষমতা। নিজেকে ভুলে যাওয়ার পরিবর্তে নিজেকে সমর্পনের মাধ্যমে রোগী যত বেশি সরাসরিভাবে যৌন উত্তেজনার চেষ্টা করে, যেমন, যৌন সুখ, ততবেশি যৌন সুখের এই অন্বেষণ আত্ম-পরাজয়মূলক হয়ে উঠে। প্রকৃত পক্ষে, যাকে আমরা pleasure principle বা সুখ তত্ত্ব বলি, সেটাই বরং এক fun-spoiler বা আনন্দ ধ্বংশকারী।

যখন জীবনের অর্থ সন্ধান করায় কোনো ব্যক্তি সফল হয়, তখন তা কেবলই তাকে সুখি করে না বরং যন্ত্রনাভোগের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সামর্থও তাকে দান করে। কি হবে যদি কারো অর্থ’র জন্য হাতড়ে বেড়ানো প্রচেষ্টায় সে ব্যর্থ হয়? তা সম্ভবত কোনো মারাত্ব অবস্থায় উপনিত হতে পারে। উদাহরণ সরুপ আমরা যুদ্ধ-বন্দীদের শিবিরে বা বন্দী শিবিরের মতো চরম পরিস্থিতিতে মাঝে মাঝে কি ঘটেছিল তা স্মরণ করা যেতে পারে। প্রথমে দিকে, আমেরিকান সৈনিকদের কর্তৃক আমাকে বলা হয়েছিল এক ধরনের আচরণ-বিধি দানা বাঁধে যাকে তারা give-up-itis হিসেবে আখ্যায়িত করতো। বন্দী শিবিরে এই আচরনের সাথে তুলনা করা হতো সকাল পাঁচটায় উঠতে এবং কাজে যাওয়ার অস্বীকৃতি জানিয়ে ছাউনিতে মল-মুত্রে সিক্ত খড়ের উপর রয়ে যাওয়া লোকদের। কোনো কিছুই – কোনো সতর্কতা বা হুমকি তাদের মন পরির্তন করাতে পারতো না। আর তারপর সাধারণ কিছু একটা ঘটে: তারা তাদের পকেটেরে গভীর থেকে লুকিয়ে রাখার একটি সিগারোট বের করে আনে আর টানতে থাকে। সেই মুহুর্তে আমরা জানতাম যে পরবর্তী আটচল্লিশ ঘন্টা বা তারও অধিক সময়ের মধ্যে আমরা তাদের মরে যেতে দেখবো। অর্থ’র সন্ধানে ছুটে চলার চেষ্টা প্রশমিত হয়ে পড়তো, আর অবশেষে তাৎক্ষনিক সুখের সন্ধান তাদের পেয়ে বসতো।

এটা কি অন্য এক সাদৃশ্যতার স্মারক নয়, এমন এক সাদৃশ্যতা যা প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের মুখোমুখি করে? আমি সেসব যুকদের কথা ভাবি যারা বিশ্বের দরবারে নিজেদেরকে no future generation বা ভবিষ্যৎহীন প্রজন্ম হিসেবে পরিচয় দেয়? বস্তুত, কেবল বন্দীদের মতো একটি সিগারেটেরে প্রতিই তারা আশ্রয় নেয় না; তারা আসলে আশ্রয় নেয় নেশা বা মানকদ্রব্যে।

প্রকৃতপক্ষে, মাদক পরিস্থিতি হলো গণ-ঘটনা প্রবাহের এক সাধারণ দিক, যেমন আমাদের অস্তিত্ত্বগত প্রয়োজনের হতাশার ফলে সৃষ্ট অর্থহীনতার অনুভূতি যা পালাক্রমে আমাদের শিল্প সমাজে এক সার্বজনিন ঘটনায় রুপ নিয়েছে। আজ কেবল লগোথেরাপিষ্টরাই অর্থহীনতার অনুভূতিকে স্নায়ুবৈকল্যের কারণ হিসেবে ক্রমবর্ধমান ভুমিকা পালন করছে বলে দাবি করছে তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্টফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরভিন ডি. ইয়ালুম Existential Psychotherapy বা “অস্তিত্ত্বগত মনোচিকিৎসা”য় বলেন: “মনঃচিকিৎসার বহিঃরোগী ক্লিনিকে থেরাপির জন্য আবেদন করা চল্লিশজন রোগীর মাঝে..বারজন (৩০ শতাংশ) মানুষের জীবনের অর্থ সম্পর্কিত কিছু প্রধান সমস্যা ছিল (আত্ম-নির্ধারন, থেরাপিষ্ট, বা স্বাধীন বিচারক থেকে সাব্যস্ত)”। [1]কালিফোর্নিয়ার পালো আল্টো থেকে হাজার হাজার মাইল পশ্চিশে পরিস্থিতির ভিন্নতা কেবল ১ শতাংশ; সবেচেয়ে সাম্প্রতিক প্রাসঙ্গিক জরিপে দেখা যায় যে ভিয়েনার ২৯ শতাংশ জনগণ অভিযোগ করে যে তাদের জীবন থেকে অর্থ হারিয়ে গেছে।

অর্থহীন অনুভূতির কারণ হিসেবে, যদিও অতিসরলীকরণ মেজাজে কেউ বলতে পারে যে জীবন ধারণের জন্য মানুষের যতেষ্ট রয়েছে কিন্তু , যার জন্য তাদের বেঁচে থাকা উচিৎ এমন কোনো কিছুই তাদের নেই; তাদের জীবন ধারনের উপায় রয়েছে তবে অর্থ নেই। নিঃসন্দে, অনেকের এমনকি স্বপ্নও নেই। বিশেষকরে, আমি আজকের দিনের বেকার বহু সংখ্যক মানুষের কথা চিন্তা করি। পঞ্চাশ বছর আগে, আমি যুবক বয়সের রোগীদের মাঝে আমার নির্ণনয় করা unemployment neurosis বা বেকারত্ব স্নায়ুবৈকল্য নামের এক বিশেষ ধরনের হতাশায় নিবেদিত একটি গবেষণা প্রকাশ করেছিলাম”।[2] আমি দেখাতে পারি যে unemployment neurosis বা বেকারত্ব স্নায়ুবৈকল্যের উৎস আসলেই এক দ্বিগুনা/দ্বিমূখী ভ্রান্ত সনাক্তকরণে: তাতে কাজহীনতাকে নিষ্ফল হওয়ার সমান বিবেচনা করা হয়েছিল, আর নিষ্ফল হওয়াকে অর্থহীন জীবনের সমান বিবেচনা করা হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে আমি যখন রোগীদের এক যুব সংঘে, বয়স্ক শিক্ষায়,গণ-পাঠাগারে ও এরকম সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্চাসেবা দানে উদ্বুদ্ধ করতে সফল হয় – বা অন্য অর্থে, যখনই তারা তাদের পর্যাপ্ত অবসর সময় কিছু অবৈতনিক কিন্তু অর্থবহ কাজের মাধ্যমে পূর্ণ করতে পারে – তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হলেও এবং ক্ষুধা একই রয়ে গেলেও তাদের হতাশা দূর হয়ে যায়। সত্যি কথা হলো যে মানুষ কেবলই কল্যাণমূলক কাজে বাচে না।

কারো আর্থসামাজিক অবস্থা দ্বারা সৃষ্ট বেকারত্ব স্নায়ুবৈকল্যের পাশাপাশি সাইকোডাইনামিক বা জৈবরসায়নিক অবস্থার দ্বারা সৃষ্ট অন্য প্রকার হতাশাও রয়েছে। তদনুসারে, সাইকোথেরাপি এবং ফার্মাসিউটিকল প্রতিষেধকের মাধ্যমে ফার্মাকোথেরাপি যথাক্রমে নির্দেশিত। যতদুর অর্থহীনতার অনুভূতি বিবেচ্য, আমাদের উপেক্ষা ও ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে, স্বতন্ত্রভাবে, এটি কোন রোগবিজ্ঞানের বিষয় নয়; বরং এক স্নায়ুবৈকল্যের চিহ্ন এবং উপসর্গ হওয়ার চেয়ে, আমি বলবো এটি কারো মনুষ্যত্ব বা মানবতার প্রমান। কিন্তু, যদিও এটি রোগবিদ্যাগত কোনো কিছুর দ্বারা সৃষ্ট নয়, তা এক রোগবিদ্যাগত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে; অন্য অর্থ এটি সম্ভাব্যভাবে রোগজনক বা রোগ ‍সৃষ্টিকারী। কেবল তরুন প্রজন্মের মাঝে বিস্তৃত গণ-স্নায়ুবৈকল্যজনিত লক্ষণকে বিবেচনা করুন: যতেষ্ট গবেষণামূলক প্রমান রয়েছে যে এই উপসর্গের তিনটি দিক – হতাশা, আগ্রাসন, আসক্তি – সমূহ লগোথেরাপি অনুযায়ী শুন্যতা আর অর্থহীনতার অনুভূতি “অস্তিত্ত্বগত শুন্যতা”র কারণে হয়ে থাকে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রতিটি হতাশার জন্য অর্থহীনতার অনুভূতি দায়ী নয়, আত্ম-হত্যাও সবসময় অস্তিত্ত্বগত শুন্যতা থেকে সৃষ্ট নয় – যাতে মাঝে মাঝে হতাশা ঘটে। কিন্তু যদি প্রতিটি আত্ম-হত্যার ঘটনা অর্থহীনতার অনুভূতি থেকে ধারণ করা না হয়, তাহলে ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে কোনো ব্যক্তির জীবন নেওয়ার তাড়নাকে অতিক্রম করা সম্ভব হতো, যদি তাকে কোনো অর্থ এবং বেঁচে থাকারযোগ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন করা হতো ।

যদি, এভাবে, আত্ম-হত্যা প্রতিরোধে কোনো ‘অর্থ স্থিতিকরণ’ সিদ্ধান্তমূলক ভুমিকা পালন করে, তাহলে আত্মহত্যার ঝুঁকি আছে এমন ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপে কি হবে? একজন যুবক ডাক্তার হিসেবে আমি অস্ট্রিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ হাসপাতালে চারবছর কাঠিয়েছিলাম করেছিলাম যেখানে আমি মারাত্মকভাবে হতাশ রোগীদের আবাসিত করা শিবিরের দায়িত্বে ছিলাম – যাদের অনেককে আত্মহত্যার প্রচেষ্টার পর সেখানে ভর্তি করা হয়েছিল। আমি একদা হিসেব করে দেখেছিলাম যে সে চার বছরে আমি বারো হাজার রোগী পরীক্ষা করেছিলাম। পুঞ্জীভূত হওয়ার মধ্যে ছিল অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার যেখান থেকে আত্মহত্যার প্রবণ কারো মুখোমুখি হলেই আমি এখনও আহরণ করি। এরকম কোনো ব্যক্তির কাছে আমি বর্ণনা করি যে আত্মহত্যার চেষ্টা সফল না হওয়াই তারা কতো খুশি ছিল তা রোগীরা আমাকে বারংবার ব্যক্ত করেছিল; বহু সপ্তাহ, বহু মাস, বহু বছর পরে তারা আমাকে বলে যে, তাদের সমস্যার সমাধান ছিল, উত্তর ছিল তাদের প্রশ্নের, আর অর্থও ছিল তাদের জীবনে। “এমনকি যদি বিষয়াধি কেবল এক হাজার ঘটনা থেকে একটি ঘটনার ক্ষেত্রে ভালোর দিকে মোড় নেয়”, আমার বর্ণনা অব্যাহত থাকে, কে নিশ্চয়তা দিতে পারে যে আপনার ক্ষেত্রে একদিন, আগে বা পরে, তা ঘটনবেনা? কিন্তু প্রথমে, আপনাকে যেদিন তা ঘটতে পারে সে দিনকে দেখার জন্য বেঁচে থাকতে হবে, তাই আপনাকে সেই ভোর দেখতে বাঁচতে হবে, আর এখন থেকে বেঁচে থাকার দায়বদ্ধতা আপনাকে ছেড়ে যাবে না”।

গণ-স্নায়ুবৈকল্যজনিত উপসর্গের দ্বিতীয় দিকের -আগ্রাবসন- সম্পর্কে এক সময় ক্যারলিন উড শেরিফ কর্তৃত পরিচালিত অনুসন্ধানের উল্লেখ করছি। তিনি বালক স্কাউট দলের মধ্যে কৃত্রিমভাবে পারস্পরিক আগ্রাসন বা বৈরি আচরণ তৈরিতে সফল হওয়ার পর লক্ষ্য করেছিলেন যে আগ্রাসন কেবল তখনই প্রশমিত হয় যখন তরুণরা নিজেদের কোনো সামগ্রিক উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছে – তা হলো তাদের ক্যাম্পে খাদ্য পবিরহন করা গাড়িটি কাদা থেকে টেনে বের করার মতো যৌথ কাজ । তাৎক্ষনিকভাবে, তারা যে কেবলই প্রতিকুলতার সম্মুখিন হয়েছিল তা নয় কিন্তু পূর্ণ করার এক অর্থ’র দ্বারা একত্রিতও হয়ে উঠেছিল তারা। [3]

গণ-স্নায়ুবৈকল্যজনিত উপসর্গের তুতীয় দিক -আসক্তি’র ব্যাপারে বলতে গেলে আমার এ্যানিমেরি ভন ফর্সটম্যায়ারের উপস্থাপন করা গবেষণার কথা মনে পড়ে, তিনি পরীক্ষা আর পরিসংখ্যান প্রমান থেকে লক্ষ্য করেছিলেন যে, তার গবেষণা করা ৯০ শতাংশ মাদক সেবনকারীরা এক ভয়ানক অর্থহীনতা অনুভূতিতে ভুগছিলো।  মাদক সেবিদের মাঝে আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ‍স্ট্যানলি ক্রিপার কর্তৃক করা গবেষণা মতে ১০০ শতাংশ মাদকসেবী বিশ্বাস করেছিলেন যে তাদের “সবকিছুকে অর্থহীন মনে হতো”। [4]

এখন চলুন আমরা স্বয়ং অর্থ’র প্রশ্নে দিকে ফিরে যায়।  শুরু করতেই, আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, সর্বাগ্রে, একজন মানুষকে তার জীবনজুড়ে যে সমস্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাতে সম্ভাব্য সহজাত ও সুপ্ত অর্থ সম্পর্কে একজন লগোথেরাপিষ্ট উদ্বিগ্ন থাকেন। এতএব, কারো জীবনের সর্বোপরি অর্থ সম্পর্কে এখানে আমি বিস্তারিত বলছি না, যদিও আমি অস্বীকার করি না যে এরকম দীর্ঘমেয়াদি অর্থ’র অস্তিত্ত্ব নাই।  উপমা হিসেবে একটি চলচ্চিত্রের কথা চিন্তা করুন: একটি চলচ্চিত্র হাজার হাজার স্বতন্ত্র ছবি নিয়ে গঠিত, আর এর প্রত্যেক ছবিরই একটি বোধ রয়েছে এবং প্রত্যেক ছবিই একটি অর্থ বহন করে এবং চলচ্চিত্রটির শেষ অনুক্রমটি প্রদর্শনের পুর্বে চলচ্চিত্রটির পুর্ণাঙ্গ অর্থ বোঝা যাবে না। সুতরাং, প্রথমে চলচ্চিত্রটির প্রতিটি উপাদান, সকল স্বতন্ত্র ছবি না বোঝা আগে সম্পুর্ণ চলচ্চিত্রটি আমরা বুঝতে পারবো না। জীবনের ক্ষেত্রেও কি একই ব্যাপার নয়? জীবনের চুড়ান্ত অর্থও কি স্বয়ং প্রকাশ হয় না, যদি আদৌ হয়ে থাকে, কেবল তার শেষান্তে, মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে? জীবনের এই চুড়ান্ত অর্থও কি প্রতিটি স্বতন্ত্র পরিস্থিতির সম্ভাব্য অর্থ স্ব স্ব ব্যক্তির জ্ঞান আর বিশ্বাস অনুযায়ী সর্বোত্তম বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা তার তার উপর নির্ভর করে না?

আসল কথা হলো যে অর্থ, আর এর ধারণা, লগোথেরাপিউটিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন দেখা হয়, বাতাসে ভাসমান বা গজদন্তমিনার বা নিভৃত স্থানের বাসিন্দার চেয়ে সম্পূর্ণরূপে বন্ধুসূলভ বিষয়। সুদূরপ্রসারীভাবে, আমি অর্থ’র চেতনা শনাক্ত করবো- মূর্ত অবস্থানের ব্যক্তিগত অর্থ’র- জার্মাণ মনোবিজ্ঞানী কার্ল বুঁহল্যার’র ধারণা এবং গ্যাষ্টাল্ট সাইকোলজির (Gestalt) উপলব্ধির পাশাপাশি, বলতে পারেন, মনোবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েরথেইমারের তত্ত্বের পাশাপাশি “আহা” অভিজ্ঞতার মাঝামাঝি স্থানে । অর্থ’র উপলব্ধি চিরায়ত গ্যাষ্টাল্ট সাইকোলজির ধারণা থেকে ভিন্ন, যতদুর গ্যাষ্টাল্ট সাইকোলজি কোনো “আয়তন”এ “আকার” সম্পর্কে আকস্মিক সতেচনতাকে বোঝায়, যেখানে অর্থ’র উপলব্ধি, আমি যেমনটা লক্ষ্য করি, আরও সুনির্দিষ্টভাবে, বাস্তবতার পটভুমির সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠাকে বোঝায়, বা সহজ কথায় ব্যক্ত করতে হলে, প্রদত্ত কোনো পরিস্থিতিতে কি করা যেতে পারে সে সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠাকে বোঝায়।

এবং একজন মানুষ কিভাবে অর্থ খুঁজার কাজ শুরু করে? চার্লট বুঁহল্যার যেমনটি বলেছিলেন: “আমরা যা করতে পারি তা হলো যারা মনে করে অবশেষে মানব জীবনের উদ্দেশ্য কি যারা খুজে পায়নি তাদের বিপরীতে তার উত্তর খুজে পেয়েছে সেসব মানুষের জীবন অধ্যয়ন করা”। [5] এরকম এক জীবনীমূলক অভিগমনের পাশাপাশি, অবশ্য, আমরা জৈবিক অভিগমনেও আরোহণ করতে পারি।  লগোথেরাপি বিবেকবোধকে এক স্মারক হিসেবে ধারণ করে যা, প্রয়োজনে, প্রদত্ত জীবন পরিস্থিতিতে আমাদের অগ্রসর হতে হয় এমন দিককে নির্দেশ করে। এরকম একটি কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য, বিবেকবোধকে মুখোমুখি হওয়া পরিস্থিতিতে এক পরিমাপের লাঠি হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে, আর এই পরিস্থিতিকে এক সেট মানদণ্ডের আলোকে, মূল্যবোধের ক্রমাধিকারতন্ত্রের আলোকে মূল্যায়ীত করতে হবে। এই মূল্যবোধ সমূহকে, যাইহোক, সচেতন পর্যায়ে আমাদের দ্বারা সমর্থনদান এবং গ্রহন করা যেতে পারেনা- তারা এমন কিছু যা আমরা।  তারা আমাদের মানবপ্রজাতির বিবর্তনের গতিপথে দানা বেঁধেছে; তারা আমাদের জৈবিক অতীতে স্থাপিত এবং আমাদের জৈবিক গভীরতায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। অস্ট্রিয়ার প্রাণিবিজ্ঞানী কনরাড লোরেঞ্জ যখন জৈবিক a priori[6] এর ধারণার বিকাশ করেছিলেন তার মনেও হয়তো একই রকম কিছু ছিল, আর আমরা দু‘জনেই যখন সম্প্রতি মূল্যবোধ প্রক্রিয়ার জৈবিক ভিত্তির উপর আমার নিজের ধারণা সম্পর্কে আলাপ করছিলাম, তখন তিনি উত্সাহের সাথেই তার সঙ্গতি ব্যক্ত করেন।  কোনো ক্ষেত্রে, যদি কোনো পূর্ব-প্রতিফলিত অ্যাক্সিওলজিকল[7] আত্ম-অনুধাবনের অস্তিত্ত্ব থাকে, তাহলে আমরা ধারণা করে নিতে পারি যে তা চুড়ান্তভাবে আমাদের জৈবিক ঐতিহ্যে নোঙরবদ্ধ।

লগোথেরাপি যেমন শিক্ষা দেয়, জীবনের অর্থে পৌঁছার জন্যে তিনটি প্রধান উপায় রয়েছে।  প্রথমটি হলো কোনো কর্ম সৃষ্টির মাধ্যমে বা কোনো কর্ম সাধনের দ্বারা। দ্বিতীয়টি হলো কোনো কিছুর অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে বা কারো মুখোমুখি হওয়ার মাধ্যমে; অন্য অর্থে জীবনের অর্থ কেবল কর্মে পাওয়া যায় না বরং ভালোবাসা বা প্রেমেও জীবনের অর্থ খুজে পাওয়া যেতে পারে। এডিথ ওয়েসকপফ জুয়েলসন এই প্রসঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন যে লগোথেরাপিউটিক অভিমত, “অভিজ্ঞতা লাভ যে অর্জনের ন্যায় মূল্যবান হতে পারে, তা থেরাপিউটিক বা চিকিৎসাসম কারণ তা অভিজ্ঞতার আভ্যন্তরীণ জগতের বিনিময়ে সফলতার বাহ্যিক জগতের উপর আমাদের এক তরফা গুরুত্বের ভারসাম্য রক্ষা করে”। [8]


[1] Basic Books, New York, 1980, p. 448.

[2]Wirtschaftskrise und Seelenleben vom Standpunkt des Jugendberaters,” Sozialärztliche Rundschau, Vol. 4 (1933), pp. 43-46.

[3] এ গবেষনার উপর আরও তত্ত্বের জন্য দেখুন Viktor E. Frankl, The Unconscious God (অবচেতন ঈশ্বর ), New York, Simon and Schuster, 1978, p. 140; and Viktor E. Frankl, The Unheard Cry for Meaning, (অর্থের জন্য না শুনা ক্রমন্দন) New York, Simon and Schuster, 1978, p. 36

[4] For further information, see The Unconscious God, pp. 97-100; and The Unheard Cry for Meaning, pp. 26-28.

[5] “Basic Theoretical Concepts of Humanistic Psychology,” American Psychologist, XXVI (April 1971), p. 378.

[6] সম্ভাব্য প্রভাবের বিষয় সম্পর্কে ধারণা দানের নীতি।

[7] Axiology– মূল্যবোধের প্রকৃতি, ধরণ, এবং মানদণ্ড এবং বিশেষত নীতিবিদ্যায় মূল্যবোধ নির্ধারণ সম্পর্কে শিক্ষা ।

[8] “The Place of Logotherapy in the World Today,” The International Forum for Logotherapy, Vol. 1, No. 3 (1980), pp. 3-7.

Romzanul Islam

Thinking out of the convention and moving forward with knowledge and reasons are always my styles. Researching, watching the best films, and reading and collecting the best books to enrich me is my deadly passion. Stoicism, liberalism, feminism and aversion to material success are my ideals.